সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

গ্লাসনস্ত ও পেরেসট্রয়িকা কি? ঠান্ডা যুদ্ধের প্রশমনে এগুলোর ভূমিকা কি?

গ্লাসনস্ত ও পেরেসট্রয়িকা কী?

গ্লাসনস্ত ও পেরেসট্রয়িকা
গ্লাসনস্ত ও পেরেসট্রয়িকা

গ্লাসনস্ত ও পেরেসট্রয়িকা :

গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রইকা শব্দ দুটি রুশ ভাষার অন্তর্ভুক্ত। গ্লাসনস্ত শব্দের অর্থ মুক্ত চিন্তা এবং পেরেস্ত্রইকা শব্দের অর্থ পুনর্গঠন

গ্লাসনস্ত ও পেরেসট্রয়িকার পটভূমি :

১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাশিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কার্যকরী করার জন্য কমিউনিস্ট সরকার। এই সরকারের মূলনীতি ছিল সম্পদের উপর সামাজিক মালিকানা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য দূর করে একটি শোষণহীন সমাজ ও অর্থ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।

এই অর্থ ব্যবস্থা ছিল ধনতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থার বিপরীত একটি ব্যবস্থা। ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের ফলে যে ধানতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এই আর্থিক ব্যবস্থা রাশিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে ধনতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষক দেশ আমেরিকার সঙ্গে রাশিয়ার মতাদর্শ গত দ্বন্দ্ব শুরু হয়।

এই দ্বন্দ্ব অর্থনৈতিক পরিসরের গণ্ডি পেরিয়ে ক্রমশ রাজনৈতিক চেহারা নেয়। ফলে শুরু হয় আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে ঠান্ডা লড়াই বা কোল্ড ওয়ার।

দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে ঠান্ডা লড়াইয়ের ফলে রাশিয়ার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সোভিয়েত ইউনিয়ন আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সুযোগে রাশিয়ায় বিপ্লব বিরোধী শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং আমেরিকারসহ ধনতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষক দেশগুলি তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিতে থাকে।

এই পরিস্থিতিতে ঘরে বাইরে বিপ্লব বিরোধী শক্তিকে প্রতিরোধ করতে কমিউনিস্ট সরকার কঠোর দমন নীতি গ্রহণ করে। ফলে মানুষের বাক স্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তার পরিসর ক্রমশ কমতে থাকে।

একদিকে আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়া এবং কঠোর দমন নীতির ফলে মানুষের বাক স্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তার পরিসর কমার ফলে দেশের অভ্যন্তরে জনরোষ তৈরি হয়। মানুষ দেশের আর্থিক ব্যবস্থা সংস্কার করার এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার পক্ষে সংঘটিত হতে থাকে।

এই পটভূমিতেই ১৯৮৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপত প্রধান মেখাইল গারবাচক দেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বপক্ষে দুটি নীতি গ্রহণ করেন।

অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন করার জন্য যে নীতি তিনি গ্রহণ করেন তা পেরেস্ত্রইকা  নামে পরিচিত। অন্যদিকে গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণার প্রচার ও প্রচার ও প্রসার ঘটানোর জন্য যে নীতি তিনি গ্রহণ করেন তা গ্লাসনস্ত নামে পরিচিতি লাভ করে।

গ্লাসনস্তের বৈশিষ্ট্য বা লক্ষ্য :

১) রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মুক্তচিন্তার পরিসর তৈরি করা।
২) ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রচার ও প্রসার ঘটানো।
৩) কমিউনিস্ট পার্টির একদলীয় শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটানো।
৪) দেশে বহুদলীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করা।
৫) কমিউনিস্ট পার্টিকে গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে আনা এবং পরিচালনা করা।
৬) সকল প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের সর্বজনীন ভোটাধিকার কার্যকরী করা।

পেরেস্ত্রইকার  বৈশিষ্ট্য বা লক্ষ্য :

কমিউনিস্ট সরকার পরিচালিত সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কার করে তাকে পুনর্গঠন করাই হলো পেরেস্ত্রইকার লক্ষ্য। এদিকে লক্ষ্য রেখেই সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান মিথাইল গর্বাচেভ যে নীতি গ্রহণ করেছিলেন তা হল:
১) সম্পত্তির ওপর সামাজিক মালিকানা তুলে দেয়া।
২) ব্যক্তি মালিকানার স্বীকৃতি দেয়া।
৩) বাজার অর্থনীতির প্রসারের পথ প্রস্তুত করা।
৪) আমেরিকার সহ ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষক দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা এবং বাণিজ্যের প্রসার ঘটানো।
৫) আমেরিকার সহ পশ্চিমী দেশগুলির সঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলা।

ঠান্ডা যুদ্ধের প্রশমনে এগুলোর ভূমিকা কী?

মিখাইল গর্বাচেভের এই সংস্কার কর্মসূচী শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। বলা ভালো তাঁর এই সংস্কার পরিকল্পনা দেশকে এক গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ত্বরান্বিত হয়। পরোক্ষ ফল হিসাবে এই পতনের ফলে আমেরিকা ও তার সহযোগীদের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের দীর্ঘদিন ধরে চলা স্নায়ু (ঠাণ্ডা লড়াই) শেষ হয়।

না হস্তক্ষেপ নীতি :

বস্তুত সংস্কারের সুত্র ধরেই, কয়েক দশক ধরে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর ওপর ব্যাপক নিয়ন্ত্রণের পর, গর্বাচেভের অধীনে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে দেয়। ঘোষণা করে যে ইউএসএসআর (সভিয়েত ইউনিয়ন) আর এই দেশগুলির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না।

বার্লিন প্রাচীর ভঙ্গ :

ফলে ১৯৮৯ সালের শেষের দিকে বার্লিন প্রাচীর ভেঙ্গে জার্মানি পুনর্মিলনের পথ তৈরি হয় এবং তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের হাত ধরে পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া এবং রোমানিয়ার মতো দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু :

পেরেসট্রয়িকা এবং গ্লাসনস্ত উভয়ের অধীনে সোভিয়েত ইউনিয়নের সংস্কার এবং পূর্ব ইউরোপে কমিউনিজমের পতনের ফলে, ১৯৮০ এর দশকের শেষের দিকে ইউএসএসআর-এর মধ্যে জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়।

সোভিয়েত দুর্বলতা ও দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে :

অন্যদিকে সংস্কারের অন্তর্নিহিত ত্রুটির ফলে কমিউনিস্ট পার্টির স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়। গর্বাচেভ কট্টরপন্থী এবং উদারপন্থী উভয়কেই সন্তুষ্ট করার জন্য তার অবস্থান পরিবর্তন করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন। পশ্চিমা সমর্থন এবং সহায়তার জন্য তার ক্রমবর্ধমান আবেদন, বিশেষ করে রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশের কাছে, সোভিয়েত রাষ্ট্রকাঠামোর দুর্বলতা ও দ্বন্দ্বকে প্রকাশ্যে এনে দেয়।

বরিস ইয়েলৎসিনের নেতৃত্বে ইয়াকোভোলেভ ও শেভারনাদজে প্রমূখ পার্টি নেতৃত্ব পূর্ণমাত্রায় বাজার অর্থনীতিসহ উদারীকরণ এবং রুশ কমিউনিস্ট পার্টিকে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টিতে রূপান্তরের দাবি জানায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে গরবাচেভ মস্কোর পার্টি প্রধানের পদ থেকে বরিশ ইয়েলৎসিনকে বহিষ্কার করেন। অন্যদিকে সংস্কারবিরোধীরা ইগর লিগাচেভ ও ভি আই ভোরেটনিকভের নেতৃত্বে জোট বাধে এবং পার্টির নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়ার জন্য গর্বাচেভকেই দায়ী করেন।

এদিকে গর্বাচেভ বিরোধী প্রচার চালিয়ে ইয়েলৎসিন বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেন। কারণ, গর্বাচেভ প্রবর্তিত সংস্কারগুলি বিশেষ সফল হয়নি। এই অবস্থায় ১৯৯১ সালের ইউনিয়ন চুক্তির দ্বারা গর্বাচেভ গণভোটের মাধ্যমে নয়টি প্রজাতন্ত্রকে আরও অধিকার দেওয়ার প্রস্তাব দেন । জুন মাসে ইয়েলৎসিন বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে রাশিয়ান ফেডারেশনের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ক্ষমতা পেয়েই তিনি রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির সমস্ত শাখা বন্ধ করে দেন।

সংস্কার বিরোধী গোষ্ঠীর অভ্যুত্থান :

এই পরিস্থিতিতে ১৯৯১ সালের আগস্টে, সংস্কার বিরোধী গোষ্ঠী  KGB-এর কিছু সদস্যের সাথে মিলে গর্বাচেভকে অপসারণের চেষ্টা করেন। কিন্তু সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়।

অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে উদারপন্থী ইয়েলৎসিন ও তার সহযোগীরা আরও শক্তি অর্জন করে। শেষ পর্যন্ত চাপে পড়ে ১৯৯১ সালের ২৫ ডিসেম্বর, গর্বাচেভ পদত্যাগ করেন। তাঁর পদত্যাগের সাথে সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে।

ঠাণ্ডা লড়াই শেষ :

উল্লেখ্য, সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতিভু আমেরিকার আধিপত্য লাভের লড়াই ছিল ঠাণ্ডা লড়াইয়ের মুল কারণ। তাই সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের হাত ধরেই বিদায় নেয় ঠাণ্ডা যুদ্ধের টান টান উত্তেজনা।
-----------xx---------

মন্তব্যসমূহ

সবচেয়ে বেশি পঠিত প্রশ্নোত্তর

আধুনিক বিজ্ঞানে গ্যালিলিওর অবদান আলোচনা কর।

আধুনিক বিজ্ঞানে গ্যালিলিওর অবদান আলোচনা কর। কোপারনিকাস ও কেপলারের পর বিজ্ঞান বিপ্লবের তৃতীয় প্রধান চরিত্র হলেন গ্যালিলিও গ্যালিলি(১৫৬৪-১৬৪২)। পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামরিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ছিলেন তিনি। মহাকাশ গবেষণায় তিনি তার নিজের হাতে তৈরি দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে কোপার্নিকাসের ধারণাকে অভ্রান্ত প্রমাণ করেন এবং পতনশীল বস্তু সম্পর্কে এরিস্টটলের বক্তব্য ভুল প্রমাণ করে নতুন তত্ত্ব তুলে ধরেন। গ্যালিলিও পতনশীল বস্তুর গতি সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের বক্তব্য ছিল, কোন একটি পদার্থের ওজনের ওপর নির্ভর করে তার গতি। ফলে একটি জিনিসের মাটিতে পড়ার গতি একটি হালকা জিনিসের থেকে দ্রুততর হয়। 1592 সালে গ্যালিলিও The Motion (De Motu) গ্রন্থে অ্যারিস্টোটলের এই ধারণার বিরোধিতা করলেন এবং বললেন যে, প্রত্যেকটি পদার্থের একটি নির্দিষ্ট ওজন আছে এবং একটি বিশেষ মাধ্যম দিয়ে যদি একটি পদার্থ চলে যায় সেই চলার গতি নির্ভর করে মাধ্যমটির ঘনত্বের উপর। পদার্থের ওজনের তারতম্য এখানে গতি নির্ধারণ করে না। কোপার্নিকাসের সমর্থক ছিলেন গ্যালিলিও। তিনি তাঁর নিজের তৈরি দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে আবিষ্কার করলেন য

কোপার্নিকান বিপ্লব বলতে কি বোঝ ?

কোপার্নিকান বিপ্লব বলতে কি বোঝ ? আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের অগ্রগতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে যার নাম প্রথমেই উচ্চারিত হবে তিনি হলেন একজন পোলিশ যাজক নিকোলাস কোপার্নিকাস (1473-1543)। রক্ষণশীল যাজক সম্প্রদায়ের অংশ হয়েও তিনি তার গবেষণার মধ্য দিয়ে চিরাচরিত পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের ধারণাকে বাতিল করে আধুনিক কসমোলজির সূচনা করেন। এই ঘটনাই কোপার্নিকান বিপ্লব নামে পরিচিত। নিকোলাস কোপার্নিকাস কোপার্নিকাসের আগে, খ্রিস্টীয় ধ্যান-ধারণার সঙ্গে সমন্বয়িত অ্যারিস্টটল ও টলেমির সৃষ্টিতত্ত্বই মান্যতা পেত। মনে করা হত যে, পৃথিবী অন্তরীক্ষের জ্যোতির্মন্ডলীর বাইরে অবস্থানরত এক মাটির জগৎ। বিপুল বিশ্বকে দ্যুলোক ও ভুলোকে বিভক্ত করে রাখা হত। দ্যুলোকে অবস্থানরত গ্রহ নক্ষত্র রাজি স্বর্গীয় ইথার দ্বারা নির্মিত। এগুলি অপরিবর্তনীয় অক্ষয় এবং এর গতি সংক্রান্ত নিয়মাবলী পৃথিবীতে অজ্ঞাত ও অপ্রাসঙ্গিক। আর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ মনে করত যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে অবস্থিত নিশ্চল পৃথিবী এবং সূর্য পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। কোপার্নিকাস তার গবেষণায় ( On the Revolutions of the Heavenly Spheres -- 1543) দেখালেন যে