সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমণের বিবরণ। অভিযানগুলির চরিত্র বিশ্লেষণ

মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমণের বিবরণ দাও। তার অভিযানগুলির চরিত্র বিশ্লেষণ কর।

Abdul Mojaffar Mondal,
Assistant professor, Sonarpur Mahavidyalaya

আফগানিস্তানের উত্তর-পশ্চিমে গজনী ও হেরাতের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত ছিল ঘুর রাজ্য। ঘুর রাজ্য প্রথমে গজনীর অধীনে ছিল। গজনীর দুর্বলতার সুযোগে ঘুর রাজ্য স্বাধীন হয়ে যায় এবং ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করে। এই দুই রাজ্য  পরস্পর বিবাদে লিপ্ত ছিল। এই বিবাদের সূত্র ধরেই 1173 খ্রিস্টাব্দে ঘুর শাসক গিয়াস উদ্দিন মোহাম্মদ গজনী রাজ্য দখল করেন এবং তিনি তাঁর ভ্রাতা মইজুদ্দিন মহম্মদ বিন সামকে গজনীর শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। ইনি ভারতের ইতিহাসে মহাম্মদ ঘুরি নামে পরিচিত। বড় ভাই এর অধীনে নিযুক্ত সেনাপতি হিসাবেই মোহাম্মদ ঘুরি ভারতে অভিযান করেছিলেন।  

মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমণের বিবরণ দাও। তার অভিযানগুলির চরিত্র বিশ্লেষণ কর।

মামুদের ভারত অভিযানের ঘটনাক্রম:

  • ১১৭৫ খ্রিস্টাব্দে ঘুরি মুলতান অধিকার এবং উচ দুর্গ দখল করে নিজ মনোনীত শাসক নিয়োগ করেন।
  • ১১৭৭ খ্রিস্টাব্দে গুজরাট অভিযান করেন এবং গুজরাটের বাঘেল বংশীয় রাজা ভীমদেবের হাতে দারুন ভাবে পরাস্ত হন।
  • ১১৭৯ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাব আক্রমন করে পেশোয়ার দখল করেন। ১১৮১ খ্রিস্টাব্দে শিয়ালকোটে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন।
  • ইতিমধ্যে ঘুরি জম্মুর রাজা বিজয়দেব এর সঙ্গে মিলিত হয়ে পাঞ্জাবে শাসনরত মামুদ এর বংশধর খুসরু মালিক কে পরাজিত করেছিলেন। ১১৮৫ খ্রিস্টাব্দে এবং ১১৮৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি পুনরায় পাঞ্জাবে লুন্ঠন চালান এবং এবারে খসরু মালিককে হত্যা করে মুলতান, সিন্ধু ও লাহোর দখল করে ভারত আক্রমণের মজবুত ভিত্তি নির্মাণ করেন।
  • ১১৮৯ খ্রিস্টাব্দে ঘুরি ভাতিন্দা আক্রমন করে নিজের পছন্দের লোককে দুর্গের অধিপতি করেন। 
  • ১১৯১ আজমিরের চৌহান রাজা পৃথ্বীরাজ এর বিরুদ্ধে ঘুরি তরাইনের প্রথম যুদ্ধে পরাস্ত হন এবং কোনক্রমে প্রাণে বাঁচেন। একমাত্র কনৌজের জয়চাঁদ ছাড়া উত্তর ভারতের রাজপুত রাজারা পৃথ্বীরাজ এর পক্ষে ছিলেন।
  • ১১৯২  তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে পৃথ্বীরাজ ঘুরির হাতে পরাজিত হন।
  • ১১৯৪ খ্রিস্টাব্দে বান্দোয়ার(যমুনার তীরে) যুদ্ধে ঘুরি কনৌজরাজ জয়চাঁদকে পরাজিত করেন। এই অভিযানে তিনি 'অসনি' দুর্গ লুঠ করেন এবং বহু মন্দির ধ্বংস করে লুণ্ঠন করেন।
  • ১১৯৭ খ্রী ঘুরির এক অনুচর কুতুবউদ্দিন গুজরাটের রাজা ভীমদেব কে পরাস্ত করেন। ১২০২ খ্রি    কালিঞ্জর দুর্গ অধিকার করেন।
  • ১১৯৭-১২০৩/৪ খ্রি তার আর এক অনুচর বখতিয়ার খলজি বিহার ও বঙ্গদেশ জয় করে।
  • ১২০৬ খ্রি পাঞ্জাবে বিদ্রোহ দমন করে ফেরার পথে এক আততায়ীর হাতে তার মৃত্যু হয়।

ঘুরির অভিযানের প্রকৃতি:

মহম্মদ ঘুরির অভিযান গুলি ছিল প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক অভিযান। তার পূর্বসূরী মাহমুদ যেখানে কেবল লুণ্ঠনমূলক উদ্দেশ্য দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলেন, সেখানে ঘুরির ভারতে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল। এই লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করার জন্য তিনি একাধিকবার পরাজয়ের শিকার (গুজরাট ও তরাইন) হলেও হার মানেননি এবং পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে ফিরে এসেছিলেন। তবে তার নামের সঙ্গে লুণ্ঠন বা মন্দির ধ্বংসের কোনও কালিমা নেই একথা বলা যাবে না। কিন্তু তা সংখ্যায় কম। তিনি একমাত্র আজমির ও বারানসি ছাড়া কোথাও মন্দির ও বিগ্রহাদি ধ্বংস করে সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানেনি। তবে তাঁর এই মন্দির ধ্বংস এবং লুন্ঠনকে তাঁর ধর্মীয় গোঁড়ামির পরিচয় হিসেবেও ব্যাখ্যা করা যায় না। কারণ তিনি ধর্মান্তকরণ প্রক্রিয়ার প্রয়োগ করেননি। তিনি তার পূর্বসূরী মামুদের মতই হিন্দু কর্মচারী নিয়োগ করতেন বা আশ্রিত হিন্দু নরপতিদের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখতে দ্বিধা করতেন না। তাছাড়া তাকে ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপন করতে গিয়ে মুসলমান রাজাদেরও পরাজিত (মামুদের বংশধর) করতে হয়েছিল। যোদ্ধা হিসেবে মামুদের মত সাফল্য লাভ করতে না পারলেও সাম্রাজ্য স্থাপক হিসাবে তিনি সফল। তাই এদিক থেকে বিচার করে অধ্যাপক শ্রীবাস্তব ঘুরিকে 'ভারতে তুর্কি সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা' বলে অভিহিত করেছেন। ভারতের তুর্কি সাম্রাজ্যের দায়িত্ব তার ক্রীতদাস অনুচর কুতুবুদ্দিন আইবকের হাতে অর্পণ করে যথার্থ রাজনৈতিক জ্ঞানের  পরিচয় দিয়েছেন। মামুদের সঙ্গে তুলনা করে ইউরোপীয় ঐতিহাসিক লেনপুন তাকে শিক্ষা ও সংস্কৃতির যথার্থ পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বিবেচিত করেননি। কিন্তু তিনি শিক্ষা ও পান্ডিত্যের প্রতি একেবারেই উদাসীন ছিলেন না। সে যুগের বিখ্যাত পণ্ডিত ও দার্শনিক ফখরুদ্দীন রাজী এবং সর্বশ্রেষ্ঠ কবি নিজামী তার দরবারের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন।

-----------------------------

 Thanks for reading.

মন্তব্যসমূহ

সবচেয়ে বেশি পঠিত প্রশ্নোত্তর

কোপার্নিকান বিপ্লব বলতে কি বোঝ ?

কোপার্নিকান বিপ্লব বলতে কি বোঝ ? আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের অগ্রগতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে যার নাম প্রথমেই উচ্চারিত হবে তিনি হলেন একজন পোলিশ যাজক নিকোলাস কোপার্নিকাস (1473-1543)। রক্ষণশীল যাজক সম্প্রদায়ের অংশ হয়েও তিনি তার গবেষণার মধ্য দিয়ে চিরাচরিত পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের ধারণাকে বাতিল করে আধুনিক কসমোলজির সূচনা করেন। এই ঘটনাই কোপার্নিকান বিপ্লব নামে পরিচিত। নিকোলাস কোপার্নিকাস কোপার্নিকাসের আগে, খ্রিস্টীয় ধ্যান-ধারণার সঙ্গে সমন্বয়িত অ্যারিস্টটল ও টলেমির সৃষ্টিতত্ত্বই মান্যতা পেত। মনে করা হত যে, পৃথিবী অন্তরীক্ষের জ্যোতির্মন্ডলীর বাইরে অবস্থানরত এক মাটির জগৎ। বিপুল বিশ্বকে দ্যুলোক ও ভুলোকে বিভক্ত করে রাখা হত। দ্যুলোকে অবস্থানরত গ্রহ নক্ষত্র রাজি স্বর্গীয় ইথার দ্বারা নির্মিত। এগুলি অপরিবর্তনীয় অক্ষয় এবং এর গতি সংক্রান্ত নিয়মাবলী পৃথিবীতে অজ্ঞাত ও অপ্রাসঙ্গিক। আর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ মনে করত যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে অবস্থিত নিশ্চল পৃথিবী এবং সূর্য পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। কোপার্নিকাস তার গবেষণায় ( On the Revolutions of the Heavenly Spheres -- 1543) দেখালেন যে...

গ্লাসনস্ত ও পেরেসট্রয়িকা কি? ঠান্ডা যুদ্ধের প্রশমনে এগুলোর ভূমিকা কি?

গ্লাসনস্ত ও পেরেসট্রয়িকা কী? গ্লাসনস্ত ও পেরেসট্রয়িকা গ্লাসনস্ত ও পেরেসট্রয়িকা : গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রইকা শব্দ দুটি রুশ ভাষার অন্তর্ভুক্ত। গ্লাসনস্ত শব্দের অর্থ মুক্ত চিন্তা এবং পেরেস্ত্রইকা শব্দের অর্থ পুনর্গঠন । গ্লাসনস্ত ও পেরেসট্রয়িকার পটভূমি : ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাশিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কার্যকরী করার জন্য কমিউনিস্ট সরকার। এই সরকারের মূলনীতি ছিল সম্পদের উপর সামাজিক মালিকানা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য দূর করে একটি শোষণহীন সমাজ ও অর্থ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। এই অর্থ ব্যবস্থা ছিল ধনতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থার বিপরীত একটি ব্যবস্থা। ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের ফলে যে ধানতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এই আর্থিক ব্যবস্থা রাশিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে ধনতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষক দেশ আমেরিকার সঙ্গে রাশিয়ার মতাদর্শ গত দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এই দ্বন্দ্ব অর্থনৈতিক পরিসরের গণ্ডি পেরিয়ে ক্রমশ রাজনৈতিক চেহারা নেয়। ফলে শুরু হয় আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে ঠান্ডা লড়াই বা কোল্ড ওয়ার। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে ঠান্ডা লড়াইয়ের ফল...

আধুনিক বিজ্ঞানে গ্যালিলিওর অবদান আলোচনা কর।

আধুনিক বিজ্ঞানে গ্যালিলিওর অবদান আলোচনা কর। কোপারনিকাস ও কেপলারের পর বিজ্ঞান বিপ্লবের তৃতীয় প্রধান চরিত্র হলেন গ্যালিলিও গ্যালিলি(১৫৬৪-১৬৪২)। পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামরিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ছিলেন তিনি। মহাকাশ গবেষণায় তিনি তার নিজের হাতে তৈরি দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে কোপার্নিকাসের ধারণাকে অভ্রান্ত প্রমাণ করেন এবং পতনশীল বস্তু সম্পর্কে এরিস্টটলের বক্তব্য ভুল প্রমাণ করে নতুন তত্ত্ব তুলে ধরেন। গ্যালিলিও পতনশীল বস্তুর গতি সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের বক্তব্য ছিল, কোন একটি পদার্থের ওজনের ওপর নির্ভর করে তার গতি। ফলে একটি জিনিসের মাটিতে পড়ার গতি একটি হালকা জিনিসের থেকে দ্রুততর হয়। 1592 সালে গ্যালিলিও The Motion (De Motu) গ্রন্থে অ্যারিস্টোটলের এই ধারণার বিরোধিতা করলেন এবং বললেন যে, প্রত্যেকটি পদার্থের একটি নির্দিষ্ট ওজন আছে এবং একটি বিশেষ মাধ্যম দিয়ে যদি একটি পদার্থ চলে যায় সেই চলার গতি নির্ভর করে মাধ্যমটির ঘনত্বের উপর। পদার্থের ওজনের তারতম্য এখানে গতি নির্ধারণ করে না। কোপার্নিকাসের সমর্থক ছিলেন গ্যালিলিও। তিনি তাঁর নিজের তৈরি দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে আবিষ্কার করলেন য...