উলেমা কারা? আকবরের সাথে উলেমা সম্প্রদায়ের সম্পর্ক কেমন ছিল ?
Abdul Mojaffar Mondal
Assistant Professor, Sonarpur Mahavidyalaya
উলেমা কারা?
ইসলাম ধর্মের পন্ডিতদের 'উলেমা' বলা হয়। 'উলেমা' শব্দটির উৎপত্তি "এলম"থেকে। এর অর্থ হল জ্ঞান। যে ব্যক্তি জ্ঞানের অধিকারী তাকে 'আলিম' বলা হয়। 'উলেমা' হল 'আলিম' শব্দের বহুবচন। স্ত্রী লিঙ্গে একবচনে 'আলিমা' এবং বহুবচনে 'উলুমা' বলা হয়। এখানে জ্ঞান বলতে প্রাথমিকভাবে ইসলামিক জ্ঞানকেই বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ উলেমা শব্দটির দ্বারা মুসলমান ধর্মীয় পন্ডিতদের একটি গোষ্ঠীকে বোঝানো হয়।মধ্যযুগে ইসলামিক রাজত্বে এই উলেমা গোষ্ঠীর যথেষ্ট প্রভাব ছিল। কোরআন, হাদিস এবং অন্যান্য ইসলামিক সাহিত্যের ওপর দক্ষতা অর্জন করলে তবেই তাকে আলিম উপাধিতে ভূষিত করা হতো। খাতা কলমে এদের কাজ ছিল রাষ্ট্র পরিচালনা এবং ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষেত্রে সুলতানকে হালাল (অর্থাৎ শাস্ত্র অনুমোদিত) এবং হারাম (অর্থাৎ অর্থশাস্ত্র অনুমোদিত নয়) বিষয়ে সচেতন করা ও পরামর্শ দেওয়া এবং সাধারণ মানুষকে আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় ক্ষেত্রে যথাযথ নেতৃত্ব দেওয়া। কে এম আশরাফ তাঁর "হিন্দুস্তানের জনজীবন ও জীবনচর্চা" গ্রন্থে দেখিয়েছেন, এদের মধ্যে যারা বিচার বিভাগীয় ও ধর্মসংক্রান্ত উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন তারা 'দস্তার-বন্দান' অথবা উষ্ণীষধারী নামে আখ্যাত হতেন; কারণ তারা সরকারি উষ্ণীষ মস্তকে ধারণ করতেন।
সুলতানি আমলে উলেমা :
সুলতানি যুগে ভারতে মুসলমান রাজাদের শাসন চালু হওয়ার সাথে সাথে এই সম্প্রদায়ের উত্থান ঘটে। জিয়াউদ্দিন বারানী ছিলেন এই সম্প্রদায়েরই একজন। উলেমা গোষ্ঠীর কাজকর্ম বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছিল সুলতানের পার্থিব ও স্বৈরাচারী শাসনের বিরোধী। তাই আলাউদ্দিন খলজি এদের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগী হয়েছিলেন। বিচার্য মামলার রায় দান ও বিশুদ্ধ ধর্মীয় ব্যাপারে সালিশী করা ছাড়া তাদের সমস্ত অধিকার কেড়ে নিয়েছিলেন। মহম্মদ বিন তুঘলক আরো এক ধাপ এগিয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থায় ওলামাদের বিশেষ মর্যাদা কে ক্ষুন্ন করলেন।মুঘল আমলে উলেমা :
আকবরের সময়
উলেমা ব্যাপারে আকবর আলাউদ্দিন খলজী বা মহম্মদ বিন তুঘলকেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। আকবরের সময় আলেমদের মধ্যে বিবাদ চরম আকার ধারন করে। আলেমদের মধ্যে পারস্পরিক বিবাদের জন্য তাঁকে ইবাদতখানা বন্ধ করে দিতে হয়। আলেমদের ব্যাক্তিগত অহমিকা এত প্রবল ছিল যে এরা একে অপরকে সহ্য করতে পারত না। তাছাড়া বিদ্যাচর্চার থেকে এরা ঐহিক লাভ-লসের হিসাবে বেশি নিমজ্জিত থাকত; যা আকবরকে ব্যাথিত করেছিল। জানা যায় যে, আব্দুন নবী সদর পদে থাকাকালীন বিপুল পরিমানে উৎকোচ গ্রহনের মাধ্যমে মাদাদ-ই-মাস (নিষ্কর) জমি দান করতেন। আব্দুল্লাহ সুলতানপুরি জাকাত ফাঁকি দেওয়ার জন্য নিজের সম্পত্তি স্ত্রীর নামে করে দেন এবং কাজ শেষ হলে পুনরায় নিজের নামে করে নেন। সতীশ্চন্দ্র লিখেছেন, কেবল এই দুজনই নয়, এরকম ভণ্ড আলেম আরও ছিলেন। মহজর জারি করে আকবর নিজেকে রাষ্ট্রের শাসনের পাশাপাশি ধর্মীয় ব্যাপারেও প্রধান বলে দাবী করেন। এরপর এই দুই ভণ্ড প্রভাবশালী আলেমকে হজযাত্রার আমীর (নেতা) করে পাঠান এবং তাদের সাম্রাজ্যে না ফেরার নির্দেশ দেন। জৌনপুরের কাজী মুল্লা মুহম্মদ ইয়েজদি আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ফতোয়া দিলে উলেমাদের একটা অংশ বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুক্ত হয়। আকবর এদের দমন করে এবং যমুনার জলে ডুবিয়ে হত্যা করেন।সমাজে উলেমাদের প্রভাব :
সমাজে আলেমদের যথেষ্ট মান্যতা ছিল। তাই তাদেরকে একেবারে অবহেলা করা যেত না। মুঘল ভারতে এরা ভরণপোষণ বাবদ নিষ্কর ভূমি পেত, যা মিলক বা মাদাদ-ই-মাস নামে পরিচিত ছিল। একইরকম নিষ্কর জমি হিন্দু পণ্ডিতরা পেতেন, যা দেবোত্তর, ব্রহ্মোত্তর নামে পরিচিত ছিল। আকবর লক্ষ্য করলেন বিপুল পরিমান মাদাদ-ই-মাস জমিলাভের কারনে আলেমরা অলস হয়ে পড়েছে এবং উৎপাদনমুখী কোন কাজই এরা করেন না। তাই ১৫৯৮ খ্রীষ্টাব্দে এক নির্দেশ জারি করে বলা হয় যে, নিষ্কর জমির অর্ধেক হবে আবাদী জমি, বাকি অর্ধেক হবে আবাদযোগ্য। যদি সবটাই আবাদী হয় তাহলে ১/৪ অংশ খালিসার অন্তর্ভুক্ত হবে।আকবর প্রকৃতপক্ষে ধর্মের বিরোধী ছিলেন না, আবার ধর্মগোঁড়াও ছিলেন না। তবে স্বৈরাচারী শাসকের অধিকারে উলেমার এক ইঞ্চিও অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ সহ্য করতেন না। তাই আর পাঁচটা রাষ্ট্রদ্রোহীর মত আলেমদেরকে শাস্তি দিতে দ্বিধাবোধ করতেন না।
কয়েকটি প্রাসঙ্গিক তথ্যঃ
নাসিরুদ্দিন বুঘরা খান ব্যাথিত চিত্তে আবিস্কার করেছিলেন যে, অভিশপ্ত স্বর্ণের মোহে বশিভূত অনৈস্লামিক ও অধার্মিক শাস্ত্র বিশারদরা কোরানের বিধানের ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল ভাষ্য করে তাঁর পুত্র কায়কোবাদকে অবশ্যপালনীয় রমজানের রোজা থেকে অব্যাহতি দিয়েছে। তিনি পুত্রদের তাই জোরালো ভাষায় এইসব 'আধুনিক' উলেমা সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছিলেন-- এরা আদৌ আস্থাযোগ্য নয়; এদের থেকে দূরে থাকাই শ্রেয়। এরা অর্থগৃধ্নু প্রবঞ্চক-- পরকলের চিন্তা এরা আদৌ করে না, ইহকালই এদের সবচেয়ে বড় আরাধ্য দেবতা।আমীর খসরুর অভিমতঃ কাজীরা ( বিচার বিভাগে নিযুক্ত উলেমা ) ইসলামীয় আইন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিল এবং রাজ্যের কোন দায়িত্বপূর্ণ পদেই নিযুক্ত হওয়ার মত প্রয়োজনীয় যোগ্যতা- না শিক্ষাগত না অন্য কোন গুন-- তাদের ছিল না। স্বেচ্ছাচারী প্রজাপীড়ক সুলতানকে সমর্থন করাই এদের একমাত্র ধর্ম। ব্যাক্তিগত জীবনধারণে তারা ধর্মীয় অনুশাসনের তোয়াক্কা রাখত না এবং অবলীলাক্রমে ইসলামের সকল বিধান লঙ্ঘন করত, অকুতোভয়ে একের পর এক পাপ কাজ করে যেত। এদের আত্মম্ভরিতা, অন্তঃসারশূন্যতা ও ভন্ডামিতেই এদের স্বতন্ত্র পরিচয় প্রকাশ পেত। বহুদিন ধরে চলে আসা গতানুগতিক রীতির জোরেই এরা জনসাধারনের কাছ থেকে সম্মান আদায় করতে পারে, নতুবা প্রকৃত গুনই যদি সামাজিক সম্মানের মানদন্ড হত তাহলে মোল্লার তুলনায় যে কোন অ-যাজক সধারন মানুষের সম্মানলাভের অধিকার সহস্রগুন বেশি ছিল।
বারানীর স্বীকারোক্তিঃ তিনি স্বীকার করেছেন যে, স্ব-শ্রেনীর অন্যান্য ব্যাক্তিদের সাথে মিলে তিনিও সুলতানকে ইসলামীয় বিধি বিধান লঙ্ঘনের ব্যাপারে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেছেন। তারা সুলতানের মনোবাঞ্ছা পূরনের জন্য কোরানের মূল আয়াতের ইচ্ছাকৃত অতিরঞ্জিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। অনুশোচনাক্লিষ্ট বিদগ্ধ ঐতিহাসিক তাই বলেছেন, অন্যদের নসিবে কি ঘটবে জানি না, কিন্তু, আমি আমার কৃতকর্মের ফলে শেষ বয়সে এত দুঃখ- দুর্দশা ভোগ করছি।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন