সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

প্রাচীন ভারতে অস্পৃশ্যতার ধারণা কিভাবে গড়ে ওঠে?

প্রাচীন ভারতে অস্পৃশ্যতার ধারণা কিভাবে গড়ে ওঠে?

Abdul Mojaffar Mondal,
Assistant Professor, Sonarpur Mahavidyalaya

জাতিপ্রথার সঙ্গে অস্পৃশ্যতাকে এক করে দেখার একটা প্রবণতা আমাদের সমাজে প্রচলিত। কিন্তু অস্পৃশ্যতার সঙ্গে জাতিপ্রথার কোন কার্যকারণ সম্পর্ক নেই এবং অস্পৃশ্যতা জাতিপ্রথার কোনও পরিনামও নয়। ভারতের জাতি কাঠামোয় একের সঙ্গে অন্যের পার্থক্য স্বীকৃত এবং প্রতিটি জাতিরই-- তা সে ব্রাহ্মণই হোক আর ডোমই হোক-- নিজস্ব ক্ষেত্রে সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত। জাতি কাঠামোয় যাদের স্থান বেশ উঁচুতে তারাও এক পঙক্তিতে ভোজন করে না। এই মনোভাবের পেছনে সম্ভবত পবিত্রতা অপবিত্রতা বোধ সংক্রান্ত কয়েকটি বিচিত্র ধারণা বর্তমান। মোটামুটিভাবে বলা যায় যে, মৃত্যু, ক্ষয়, দৈহিক পরিতক্ত সামগ্রী, রোগ, অপরিচ্ছন্নতা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে এখানে পবিত্রতা-অপবিত্রতার ধারণা গড়ে উঠেছে। জীবন যেহেতু পবিত্র সেহেতু জীবনহানিকর কোন পেশা, যেমন শিকার, অপবিত্র। মৃত জীব স্বাভাবিকভাবেই তাই অপবিত্র এবং যেসব মানুষেরা মৃত জীবের চামড়া, নাড়িভুঁড়ি ইত্যাদি নিয়ে কাজকর্ম করে বা কসাইয়ের কাজ করে তাদের পেশা অপবিত্র। আবার রজস্বলা নারী, সে যতই নিকট আত্মীয়া হোক না কেন, অপবিত্র রূপে গণ্য। কোনো ঘনিষ্ঠ বান্ধবের শোক-অশৌচকালে তাকে স্পর্শ করা নিষেধ।

অস্পৃশ্যতা সংক্রান্ত ধ্যান ধারণার উদ্ভব এর পিছনে সম্ভবত গুরুতর অপরাধের জন্য জাতিচ্যুতির বিধান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। মনুর বিধান অনুযায়ী যে ব্রহ্মহত্যা করে, ব্রাহ্মণ সর্বস্ব হরণ করে, মাদক দ্রব্য ব্যবহার ও অপরাপর নিন্দিত কর্ম করে তাহলে কেউ যেন তাদের সঙ্গে ভজন না করে, তাদের শিক্ষাদান না করে, তাদের পৌরহিত্য না করে, তাদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন না করে, কেননা তারা বৈদিক ধর্ম থেকে বিচ্যুত। দ্বিতীয়ত, বিধর্মীরা কোনও কোনও ক্ষেত্রে অস্পৃশ্য হিসাবে গণ্য। অপরার্ক ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ উদ্ধৃত করে বলেন যে, বৌদ্ধ, জৈন, লোকায়ত, কপিল, বেয়াড়া ব্রাহ্মণ এবং নাস্তিকদের স্পর্শ করলে স্নান করতে হয়। তৃতীয়তঃ ভিন্ন সংস্কৃতির বা বাইরে দেশের লোকেরা যারা ম্লেচ্ছ হিসেবে পরিগণিত তাদেরও অপবিত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। চতুর্থত বংশানুক্রমিকভাবে কোন জাতি অপবিত্র বৃত্তি গ্রহণ করলে তারাও অপবিত্র হয়ে যায়।

অস্পৃশ্য হিসেবে বরাবরের ছাপ মারা কোনও জাতি না থাকলেও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে অন্ত্যজ,অন্তবসায়ী ও চণ্ডাল শ্রেণীভুক্ত জাতিরা অস্পৃশ্যদের কোঠায় পড়ে। অস্পৃশ্য শব্দটির প্রথম প্রত্যক্ষ উল্লেখ পাওয়া যায় বিষ্ণুধর্ম সূত্রে, যেখানে চন্ডাল,ম্লেচ্ছ ও পারসিকদের অস্পৃশ্য বলা হয়েছে। সংকীর্ণ অর্থে চন্ডাল বলতে প্রতিলোম শংকর একটি বিশেষ জাতিকেই বোঝায় যাদের সামাজিক মর্যাদা সাধারণ যে কোনও প্রতিলোম শঙ্কর জাতিরই অনুরূপ ছিল। কিন্তু ব্যাপকতর অর্থে চন্ডাল শব্দটির দ্বারা অন্ত্যজ পর্যায়ের অনেক জাতিকেই বোঝায়। মনু অন্ধ্র, মেদ, চন্ডাল ও শ্বপচ দের বাসস্থান গ্রাম কিংবা নগরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নির্দিষ্ট করেছেন। ফাহিয়েন এর লেখা থেকে জানা যায় যে, বাজার এলাকায় চন্ডালরা প্রবেশ করলে তারা লাঠি ঠুকে নিজেদের উপস্থিতি জানাত, যাতে অন্যান্যরা তাদের সংসর্গ এড়িয়ে চলতে পারে। অপরার্ক হারীত উদ্ধৃত করে বলেন যে, রজক, চর্মকার, নট, বুরুড়, মেদ প্রভৃতি অন্ত্যজদের সঙ্গে স্পর্শ ঘটে গেলে দেহের যে অংশে স্পর্শ ঘটেছে সেই অংশটুকু ধুয়ে ফেলতে হবে। যেখানে অঙ্গির: বলেন যে, এমতাবস্থায় একবার আচমন করলেই যথেষ্ট। পক্ষান্তরে নিত্যাচার পদ্ধতি গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, চন্ডাল বা পুককস শুদ্ধ অবস্থায় থাকলে সেই সময় স্পর্শ ঘটে গেলে কিছুই করতে হয়না। 'চণ্ডালের ছায়া মাড়ানো পাপ', মনুর নামে আরোপিত এই বক্তব্যটি সর্বৈব মিথ্যা।

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে, এই সকল জাতির পতিত দশা একদিনে হয়নি। সমাজে প্রথম অপবিত্রতা, অপরিচ্ছন্নতা দূষণ প্রভৃতি ধারণাগুলি আবির্ভাব হয়। এই ধারণার সঙ্গে তারপর কোন বৃত্তের সংযোগ স্থাপিত হয় এবং সেই বৃত্তি গুলি অপবিত্র হিসাবে গণ্য করা হয়। এই সকল বৃত্তিজীবী জাতিরা নিজেদের পেশার জন্যই অন্যান্য 'পরিচ্ছন্ন বৃত্তিজীবী' থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং ক্রমশ তা ছুৎ-অচ্ছুতে পরিণত হয়।

তবে এই সকল জাতির পতিতদশা সর্বত্র একই ভাবে হয়নি। কাশ্মীরে ডোম ও চন্ডালরা নিজ জাতি বলে গণ্য হলেও রাজতরঙ্গিনী থেকে জানা যায় যে, তারা সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করতে পারত এবং তাদের মধ্যে বিচক্ষণরা ওপর তলার মানুষদের সঙ্গে নানা ধরনের সম্পর্ক রাখত। বঙ্গদেশের ডেমরা একদা সামরিক জাতি হিসাবে প্রসিদ্ধ হয়েছিল। কৃত্তিবাসী রামায়ণে রামচন্দ্রের বন্ধু গুহক ছিলেন একজন চণ্ডাল।

মন্তব্যসমূহ

সবচেয়ে বেশি পঠিত প্রশ্নোত্তর

কোপার্নিকান বিপ্লব বলতে কি বোঝ ?

কোপার্নিকান বিপ্লব বলতে কি বোঝ ? আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের অগ্রগতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে যার নাম প্রথমেই উচ্চারিত হবে তিনি হলেন একজন পোলিশ যাজক নিকোলাস কোপার্নিকাস (1473-1543)। রক্ষণশীল যাজক সম্প্রদায়ের অংশ হয়েও তিনি তার গবেষণার মধ্য দিয়ে চিরাচরিত পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের ধারণাকে বাতিল করে আধুনিক কসমোলজির সূচনা করেন। এই ঘটনাই কোপার্নিকান বিপ্লব নামে পরিচিত। নিকোলাস কোপার্নিকাস কোপার্নিকাসের আগে, খ্রিস্টীয় ধ্যান-ধারণার সঙ্গে সমন্বয়িত অ্যারিস্টটল ও টলেমির সৃষ্টিতত্ত্বই মান্যতা পেত। মনে করা হত যে, পৃথিবী অন্তরীক্ষের জ্যোতির্মন্ডলীর বাইরে অবস্থানরত এক মাটির জগৎ। বিপুল বিশ্বকে দ্যুলোক ও ভুলোকে বিভক্ত করে রাখা হত। দ্যুলোকে অবস্থানরত গ্রহ নক্ষত্র রাজি স্বর্গীয় ইথার দ্বারা নির্মিত। এগুলি অপরিবর্তনীয় অক্ষয় এবং এর গতি সংক্রান্ত নিয়মাবলী পৃথিবীতে অজ্ঞাত ও অপ্রাসঙ্গিক। আর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ মনে করত যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে অবস্থিত নিশ্চল পৃথিবী এবং সূর্য পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। কোপার্নিকাস তার গবেষণায় ( On the Revolutions of the Heavenly Spheres -- 1543) দেখালেন যে...

আর্য কারা? আর্যদের আদি বাসভূমি

আর্য কারা? আর্যদের আদি বাসভূমি কোথায় ছিল? আর্যদের আদি বাসভূমি আর্যদের উৎপত্তি বিষয়ক বিতর্ক সম্পর্কে বিস্তারিত লেখ। আর্য কারা, তাদের আদি বাসস্থান কোথায় ছিল, তাদের সংস্কৃতির রূপ কেমন, কীভাবে তারা ভারত সহ ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ল — এসব নিয়ে প্রায় ২০০ বছর ধরে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক চলছে। এ বিষয়ে এক ডজনেরও বেশি তত্ত্ব আছে। তবে এদের মধ্যে মূল সমস্যা হল আর্যরা ভারতে বহিরাগত, না কি ভারতই তাদের আদি বাসস্থান। বলাবাহুল্য, এ বিষয়ে স্থির নিশ্চিত প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক, ভাষাতাত্ত্বিক এবং বস্তুগত সাংস্কৃতিক জোরাল প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে বর্তমানে পৃথিবীর অধিকাংশ পন্ডিতই একমত যে, ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষী মানুষদের একটি শাখা ছিল আর্য। তারা বাইরে থেকে ভারতে এসেছিলেন এবং হরপ্পা সভ্যতার পরে নতুন সভ্যতার সৃষ্টি করেছিলেন এবং এখানে বৈদিক যুগের সূচনা করেছিলেন। আর্য কারা? জার্মান ভাষাতত্ত্ববিদ ম্যাক্সমূলার বলেন, আর্য শব্দটি জাতিবাচক নয়; ধর্মবোধক তো নয়ই। আর্য একটি ভাষা গোষ্ঠীর নাম এবং যারা ওই ভাষায় কথা বলতেন, তারাই আর্য। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে, এশিয়াটিক সোসাইটির প্...

গ্লাসনস্ত ও পেরেসট্রয়িকা কি? ঠান্ডা যুদ্ধের প্রশমনে এগুলোর ভূমিকা কি?

গ্লাসনস্ত ও পেরেসট্রয়িকা কী? গ্লাসনস্ত ও পেরেসট্রয়িকা গ্লাসনস্ত ও পেরেসট্রয়িকা : গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রইকা শব্দ দুটি রুশ ভাষার অন্তর্ভুক্ত। গ্লাসনস্ত শব্দের অর্থ মুক্ত চিন্তা এবং পেরেস্ত্রইকা শব্দের অর্থ পুনর্গঠন । গ্লাসনস্ত ও পেরেসট্রয়িকার পটভূমি : ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাশিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কার্যকরী করার জন্য কমিউনিস্ট সরকার। এই সরকারের মূলনীতি ছিল সম্পদের উপর সামাজিক মালিকানা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য দূর করে একটি শোষণহীন সমাজ ও অর্থ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। এই অর্থ ব্যবস্থা ছিল ধনতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থার বিপরীত একটি ব্যবস্থা। ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের ফলে যে ধানতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এই আর্থিক ব্যবস্থা রাশিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে ধনতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষক দেশ আমেরিকার সঙ্গে রাশিয়ার মতাদর্শ গত দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এই দ্বন্দ্ব অর্থনৈতিক পরিসরের গণ্ডি পেরিয়ে ক্রমশ রাজনৈতিক চেহারা নেয়। ফলে শুরু হয় আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে ঠান্ডা লড়াই বা কোল্ড ওয়ার। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে ঠান্ডা লড়াইয়ের ফল...