সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আকবরের ধর্মনীতির বিবর্তন

আকবরের ধর্মনীতির বিবর্তন আলোচনা কর।

মুঘল শাসকদের মধ্যে ধর্ম বিষয়ে সবচেয়ে উদার মানসিকতার অধিকারী ছিলেন আকবর। রাষ্ট্রপরিচালনায় আকবরের পরধর্মসহিষ্ণুতার নীতি সুল-ই-কুল নামে পরিচিত। সুলতানি যুগ থেকে ভক্তি ও সুফিবাদী সাধকেরা যে সমন্বয়বাদী চিন্তাধারার প্রচলন করেছিলেন আকবরের ধর্মনীতি ছিল তারই ফলশ্রুতি। আকবর উপলব্ধি করেছিলেন যে, বিশাল ভারতবর্ষ এর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ হল হিন্দু। তাদের সহযোগিতা ছাড়া ভারতবর্ষে শক্তিশালী শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। তাই তার পক্ষে সহিষ্ণুতার নীতি গ্রহণ না করে কোন উপায়ও ছিল না।


আকবরের ধর্মনীতির বিবর্তন আলোচনা কর।
সম্রাট আকবর

আকবর তার প্রথম জীবনে ধর্মভীরু মুসলমান ছিলেন। নিয়মিত রোজা নামাজ পালন করতেন। ১৫৬২ খ্রিস্টাব্দে আজমীর থেকে ফেরার পথে তিনি অম্বরের রাজা ভরমলের কন্যাকে বিবাহ করেন। এরপর থেকেই তিনি এমন কিছু পদক্ষেপ নেন যার মাধ্যমে হিন্দু জনতার মন জয় করতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যেই তিনি 1563 খ্রিস্টাব্দে তীর্থযাত্রা কর রদ করেন। পরের বছরই জিজিয়া কর রদ করেন। এই দুটি পদক্ষেপ তাকে রাজপুতদের সমর্থন অর্জনে সাহায্য করেছিল।

দ্বিতীয় পর্যায়ে আকবর ধর্মের সত্য অন্বেষণে ব্রতী হন। এই উদ্দেশ্যে ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি ফতেপুর সিক্রিতে ইবাদৎখানা স্থাপন করেন। প্রতি শুক্রবার এখানে মুসলমান পণ্ডিতদের নিয়ে এক আলোচনাসভা বসত। সেখানে তারা আকবরের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতেন। কিন্তু পণ্ডিতদের পারস্পরিক ব্যক্তিআক্রমণের ফলে আকবর ইবাদতখানা বন্ধ করে দেন। ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় ইবাদতখানার দরজা খোলা হয়। এবার হিন্দু, জৈন, পারসিক, ক্রিস্টান সহ বিভিন্ন ধর্মের পণ্ডিতদের ইবাদাতখানার আলোচনা সভায় আমন্ত্রণ করা হয়। তার উদ্দেশ্য ছিল তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে প্রকৃত সত্য উদঘাটন করা। পরিশেষে তিনি উপলব্ধি করেন যে কোন ধর্মই একক ভাবে সত্য নয়। এরপর আকবর ব্যক্তিগত জীবনে কতগুলি পরিবর্তন আনেন। নিরামিষ ভক্ষণ, কপালে তিলক কাটা, শিকার নিষিদ্ধ করা, এবং অগ্নি উপাসনায় উৎসাহ দেওয়া শুরু করেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে উলেমা গোষ্ঠীর সঙ্গে আকবরের সম্পর্ক অত্যন্ত খারাপ হয়। আকবর ১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দে ২২ জুন ফতেপুর সিক্রি মসজিদের প্রধান পুরোহিতকে বিতাড়িত করে নিজেকে ইমাম বলে দাবি করেন। এবং নিজ নামে খুতবা পাঠ করেন। ২রা সেপ্টেম্বর শেখ মুবারক রচিত মহাজরনামা ঘোষণা করে উলেমা গোষ্ঠীর ধর্মনৈতিক অধিকার সম্পূর্ণরূপে খর্ব করে নিজেকে রাষ্ট্র' এবং ধর্ম ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার অধিকারী বলে ঘোষণা করেন।

আকবরের ধর্মনৈতিক জীবনের অভিনব ব্যাখ্যা দিয়েছেন আলীগড় গবেষক ইকতিদার আলাম খান। তার মতে, আকবরের ধর্মনীতির পশ্চাতে কোনো উদার মনোভাব বা বৌদ্ধিক প্রভাব ছিল না। তিনি যা করেছেন তা রাষ্ট্রনৈতিক প্রয়োজনেই করেছেন। পুরানো অভিজাতদের প্রতি বিদ্বিষ্ট হয়েই তিনি রাজপুত ও ভারতীয়দের রাজকার্যে নিয়োগ করে একটা ভারসাম্য আনতে চেয়েছেন। এই উদ্দেশ্যেই তিনি রাজপুতদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেন এবং তীর্থযাত্রা কর ও জিজিয়া কর রদ করেন। উজবেগ বিদ্রোহ দমনের পর থেকেই তার ধর্ম নীতিতে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় এবং গোঁড়া মুসলিমদের খুশি করার চেষ্টা করতে থাকেন। ১৫৬৮ খ্রিস্টাব্দে চিতোর দখলকে তিনি বিধর্মীদের বিরুদ্ধে ইসলামের জয় বলে ঘোষণা করেন। ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি জিজিয়া পুনর্বহাল করেন। তার মহজর ঘোষণা হল নিজেকে গোঁড়া মুসলমানদের একমাত্র প্রধান হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার প্রচেষ্টা। ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে অভিজাত বিদ্রোহের পর আকবর বুঝতে পারেন যে, তুর্কি ও পারসিকদের তার এই নীতি প্রভাবিত করতে পারেনি। তাই আকবর নিঃশব্দে মহজর ঘোষণা বাতিল করে দেন এবং দ্বিতীয় বার জিজিয়া কর বাতিল করা হয়। এই বিপর্যয়ের পরই ধীরে ধীরে আকবর ইসলামের নীতি প্রনয়নের বাধ্যবাধকতা থেকে সরে আসেন এবং দ্বীন-ই-ইলাহীর ভাবনা দানা বেধে ওঠে।

আকবরের ধর্মনৈতিক জীবনের চরম পরিনতি হল দ্বীন-ই-ইলাহী। ১৫৮১ খ্রিস্টাব্দে আকবর তার এই উদার দর্শনের ঘোষণা করেন। বিভিন্ন ধর্মের সারবস্তু নিয়ে এই ধর্মমত গঠিত হয়। এটি একপ্রকার বহুঈশ্বরবাদী দর্শন এবং রহস্যবাদ ও প্রকৃতি উপাসনা এই ধর্মে স্থান পেয়েছে। এই ধর্মে বিশ্বাসীদের দানধর্ম পালন করতে হত, গোমাংস ভক্ষণে বিরত থাকতে হত এবং পরস্পরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে আল্লাহ-হ-আকবর (ঈশ্বর মঙ্গলময়) এবং প্রতুত্তরে জাল্লা-জালাল্লাহ (তার মহিমা বিকশিত হোক)। বদাউনির মতে দ্বীন-ই-ইলাহী ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করলে সম্রাটের জন্য সম্পদ, মান, ধর্ম ও জীবন বিসর্জন দেওয়ার শপথ গ্রহণ করতে হত। । এই ধর্ম প্রচারের জন্য আকবর কোন উদ্যোগ নেননি। মাত্র ১৮ জন ব্যক্তি দ্বীন-ই-ইলাহী স্বীকার করেছিলেন এবং তারা সকলেই রাজদরবারের লোক ছিলেন। তাই দ্বীন-ই-ইলাহী যে উদ্দেশ্যেই গড়ে উঠুক না কেন তা লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছিল।

গোঁড়া মোল্লারা আকবরের এই উদারতাকে বিদ-আত বা নবীর তরীকার বিরোধী আচরণ বলে অভিযোগ করেছিলেন। এমনকি বদাউনিও এরকম অভিমত ব্যাক্ত করেছেন। জেসুইটস পাদরিরাও ঐ একই অভিযোগ করেছিলেন। আধুনিক ঐতিহাসিকগণ অবশ্য আকবরের ইসলাম ত্যাগের কথা মানেন না। পাকিস্তানি ঐতিহাসিক হোসেন কুরেশি বলেছেন যে, আকবর তার কোনও অনুচরকে ইসলাম ত্যাগ করতে বলেন নি, বলেছিলেন ইসলামের গোঁড়ামি ত্যাগ করতে। প্রকৃতপক্ষে আকবর এমন একটা ইসলাম চেয়েছিলেন যেটা এমন নমনীয় হবে যে রাজনৈতিক বিপদ গুলির মোকাবিলা করতে পারবে এবং যেটা মানুষের যুক্তির কাছে আর্জি জানাতে পারবে। যদিও সেযুগে এই কাজ অত্যন্ত কঠিন ছিল। তবু তাঁর এই মহান উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসার যোগ্য।

মন্তব্যসমূহ

সবচেয়ে বেশি পঠিত প্রশ্নোত্তর

কোপার্নিকান বিপ্লব বলতে কি বোঝ ?

কোপার্নিকান বিপ্লব বলতে কি বোঝ ? আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের অগ্রগতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে যার নাম প্রথমেই উচ্চারিত হবে তিনি হলেন একজন পোলিশ যাজক নিকোলাস কোপার্নিকাস (1473-1543)। রক্ষণশীল যাজক সম্প্রদায়ের অংশ হয়েও তিনি তার গবেষণার মধ্য দিয়ে চিরাচরিত পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের ধারণাকে বাতিল করে আধুনিক কসমোলজির সূচনা করেন। এই ঘটনাই কোপার্নিকান বিপ্লব নামে পরিচিত। নিকোলাস কোপার্নিকাস কোপার্নিকাসের আগে, খ্রিস্টীয় ধ্যান-ধারণার সঙ্গে সমন্বয়িত অ্যারিস্টটল ও টলেমির সৃষ্টিতত্ত্বই মান্যতা পেত। মনে করা হত যে, পৃথিবী অন্তরীক্ষের জ্যোতির্মন্ডলীর বাইরে অবস্থানরত এক মাটির জগৎ। বিপুল বিশ্বকে দ্যুলোক ও ভুলোকে বিভক্ত করে রাখা হত। দ্যুলোকে অবস্থানরত গ্রহ নক্ষত্র রাজি স্বর্গীয় ইথার দ্বারা নির্মিত। এগুলি অপরিবর্তনীয় অক্ষয় এবং এর গতি সংক্রান্ত নিয়মাবলী পৃথিবীতে অজ্ঞাত ও অপ্রাসঙ্গিক। আর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ মনে করত যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে অবস্থিত নিশ্চল পৃথিবী এবং সূর্য পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। কোপার্নিকাস তার গবেষণায় ( On the Revolutions of the Heavenly Spheres -- 1543) দেখালেন যে...

গ্লাসনস্ত ও পেরেসট্রয়িকা কি? ঠান্ডা যুদ্ধের প্রশমনে এগুলোর ভূমিকা কি?

গ্লাসনস্ত ও পেরেসট্রয়িকা কী? গ্লাসনস্ত ও পেরেসট্রয়িকা গ্লাসনস্ত ও পেরেসট্রয়িকা : গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রইকা শব্দ দুটি রুশ ভাষার অন্তর্ভুক্ত। গ্লাসনস্ত শব্দের অর্থ মুক্ত চিন্তা এবং পেরেস্ত্রইকা শব্দের অর্থ পুনর্গঠন । গ্লাসনস্ত ও পেরেসট্রয়িকার পটভূমি : ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাশিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কার্যকরী করার জন্য কমিউনিস্ট সরকার। এই সরকারের মূলনীতি ছিল সম্পদের উপর সামাজিক মালিকানা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য দূর করে একটি শোষণহীন সমাজ ও অর্থ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। এই অর্থ ব্যবস্থা ছিল ধনতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থার বিপরীত একটি ব্যবস্থা। ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের ফলে যে ধানতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এই আর্থিক ব্যবস্থা রাশিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে ধনতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষক দেশ আমেরিকার সঙ্গে রাশিয়ার মতাদর্শ গত দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এই দ্বন্দ্ব অর্থনৈতিক পরিসরের গণ্ডি পেরিয়ে ক্রমশ রাজনৈতিক চেহারা নেয়। ফলে শুরু হয় আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে ঠান্ডা লড়াই বা কোল্ড ওয়ার। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে ঠান্ডা লড়াইয়ের ফল...

আধুনিক বিজ্ঞানে গ্যালিলিওর অবদান আলোচনা কর।

আধুনিক বিজ্ঞানে গ্যালিলিওর অবদান আলোচনা কর। কোপারনিকাস ও কেপলারের পর বিজ্ঞান বিপ্লবের তৃতীয় প্রধান চরিত্র হলেন গ্যালিলিও গ্যালিলি(১৫৬৪-১৬৪২)। পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামরিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ছিলেন তিনি। মহাকাশ গবেষণায় তিনি তার নিজের হাতে তৈরি দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে কোপার্নিকাসের ধারণাকে অভ্রান্ত প্রমাণ করেন এবং পতনশীল বস্তু সম্পর্কে এরিস্টটলের বক্তব্য ভুল প্রমাণ করে নতুন তত্ত্ব তুলে ধরেন। গ্যালিলিও পতনশীল বস্তুর গতি সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের বক্তব্য ছিল, কোন একটি পদার্থের ওজনের ওপর নির্ভর করে তার গতি। ফলে একটি জিনিসের মাটিতে পড়ার গতি একটি হালকা জিনিসের থেকে দ্রুততর হয়। 1592 সালে গ্যালিলিও The Motion (De Motu) গ্রন্থে অ্যারিস্টোটলের এই ধারণার বিরোধিতা করলেন এবং বললেন যে, প্রত্যেকটি পদার্থের একটি নির্দিষ্ট ওজন আছে এবং একটি বিশেষ মাধ্যম দিয়ে যদি একটি পদার্থ চলে যায় সেই চলার গতি নির্ভর করে মাধ্যমটির ঘনত্বের উপর। পদার্থের ওজনের তারতম্য এখানে গতি নির্ধারণ করে না। কোপার্নিকাসের সমর্থক ছিলেন গ্যালিলিও। তিনি তাঁর নিজের তৈরি দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে আবিষ্কার করলেন য...