সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আর্য কারা? আর্যদের আদি বাসভূমি

আর্য কারা? আর্যদের আদি বাসভূমি কোথায় ছিল?

Write in detail about the debate of the origins of Aryans.
আর্যদের আদি বাসভূমি

আর্যদের উৎপত্তি বিষয়ক বিতর্ক সম্পর্কে বিস্তারিত লেখ।

আর্য কারা, তাদের আদি বাসস্থান কোথায় ছিল, তাদের সংস্কৃতির রূপ কেমন, কীভাবে তারা ভারত সহ ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ল — এসব নিয়ে প্রায় ২০০ বছর ধরে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক চলছে। এ বিষয়ে এক ডজনেরও বেশি তত্ত্ব আছে। তবে এদের মধ্যে মূল সমস্যা হল আর্যরা ভারতে বহিরাগত, না কি ভারতই তাদের আদি বাসস্থান।

বলাবাহুল্য, এ বিষয়ে স্থির নিশ্চিত প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক, ভাষাতাত্ত্বিক এবং বস্তুগত সাংস্কৃতিক জোরাল প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে বর্তমানে পৃথিবীর অধিকাংশ পন্ডিতই একমত যে, ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষী মানুষদের একটি শাখা ছিল আর্য। তারা বাইরে থেকে ভারতে এসেছিলেন এবং হরপ্পা সভ্যতার পরে নতুন সভ্যতার সৃষ্টি করেছিলেন এবং এখানে বৈদিক যুগের সূচনা করেছিলেন।

আর্য কারা?

জার্মান ভাষাতত্ত্ববিদ ম্যাক্সমূলার বলেন, আর্য শব্দটি জাতিবাচক নয়; ধর্মবোধক তো নয়ই। আর্য একটি ভাষা গোষ্ঠীর নাম এবং যারা ওই ভাষায় কথা বলতেন, তারাই আর্য। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে, এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম জোনস আবিষ্কার করেছিলেন যে, সংস্কৃত, গ্রীক, ল্যাটিন ও অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষার মধ্যে যথেষ্ট মিল রয়েছে। আর এরই ভিত্তিতে ১৯ শতকে ধরে নেওয়া হয়েছিল আর্যরা একই নরগোষ্ঠীর বংশধর। মনে রাখা প্রয়োজন, ১৮৮৮ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘বিবলিওগ্রাফিস্ অফ দ্য ওয়ার্ডস, এন্ড দ্য হোম অফ দ্যা এরিয়েন্স’ গ্রন্থে এই তত্ত্বের বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন।

বলাবাহুল্য, এই ভ্রান্ত ধারণা বিশ শতকের তৃতীয় দশকে ফ্যাসিস্ট জার্মানদের ইহুদি নিপীড়নের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। কারণ, জার্মানরা মনে করত তারাই বিশুদ্ধ আর্য জাতি।

কিন্তু আধুনিক পন্ডিতরা তাদের গবেষণায় প্রমাণ করেছেন, একই ভাষাভাষী হলেও আর্যরা একই নরগোষ্ঠী বা জাতিভুক্ত হবেন এমন কোন কথা নেই। বস্তুত আর্য সমস্যা মূলত ভাষাগত সমস্যা এবং আর্য সমস্যার সমাধানে ভাষাতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণই বেশি সাহায্য করে।

আর্যদের আদিবাসভূমি :

আর্যরা বহিরাগত :

অধ্যাপক রামচরণ শর্মা আর্য সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ নিশানাগুলোকে চিহ্নিত ও বিশ্লেষণ করে বস্তুতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সাংস্কৃতিক মাত্রাগুলি বিবেচনা করেছেন। আর্য ভাষার প্রাচীনতম লেখগুলি পাওয়া যায় বহির্ভারতে। তাছাড়া অশ্বের ও অর (স্পোক) যুক্ত চাকার ব্যবহার, মৃতের অন্তেষ্টি, অগ্নি উপাসনা, সোম বিশ্বাস, পশু বলিদান বিশেষত অশ্বমেধ যজ্ঞ, জীবিকার উপায় ও পুরুষ প্রাধান্য, স্বস্তিকা প্রতীকের ব্যবহার — সবই ভারতের আগে বহির্ভারতে দেখা গেছে। এইসব ভাষাতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের নিরিখে তিনি তাঁর ‘অ্যাডভেন্ট অফ দা এরিয়ানস’ নামক গ্রন্থে আর্যদেরকে ভারতের বাইরে থেকে আসা গোষ্ঠীর মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

আর্যরা বহিরাগত, স্বপক্ষে যুক্তি :

  1. গৃহপালিত পশু অশ্ব ও তার পরিব্যক্তি : অশ্ব, গো এবং বৃষভ আর্য সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই প্রাণীগুলোর নাম বিশেষ করে অশ্ব আদি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষায় এবং সাহিত্যে (যেমন, আবেস্তান সাহিত্যে) বহুল ব্যবহৃত। একইভাবে বৈদিক সাহিত্যেও এসেছে বারংবার। ঋকবেদে অশ্ব শব্দটি এসেছে ২১৫ বার, গো শব্দটি ১৭৬ বার এবং বিষভ শব্দটি ১৭০ বার উল্লেখিত হয়েছে। প্রাচীনতম গৃহপালিত এই অশ্বের সর্বাধিক সন্ধান পাওয়া গেছে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে বহু দূরে নিপার ও ভলগা নদীর অন্তর্বর্তী অঞ্চলে। প্রত্নতত্ত্বের দিক থেকে প্রথম অশ্বের দর্শন পাওয়া গেছে খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ অব্দ নাগাদ দক্ষিণ ইউরাল অঞ্চলে। ₁
  2. যুদ্ধ রথের ব্যবহার : ইন্দো-ইউরোপীয়রা বহুল পরিমাণে অশ্ববাহিত রথের ব্যবহার করত। বৈদিক, আবেস্তান এবং হোমারের সাহিত্যে এই রথের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই কাঠের চাকাওয়ালা রথ পশ্চিম এশিয়াতে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দে প্রথম নির্মিত হয়। হরপ্পার সময় মাটির চাকার কথা এলেও তা ২৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের আগের নয়।
  3. অর (স্পোক )-যুক্ত চাকার ব্যবহার : অর-যুক্ত চাকার আবির্ভাব ঘটে ইরানের হিসারে এবং উত্তর ককেশাস অঞ্চলে খ্রিস্টপূর্ব ২৩০০ অব্দ নাগাদ।₂ কিন্তু হরপ্পা কিংবা মহেঞ্জোদারো এলাকায় অর-যুক্ত চাকার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
  4. ঘোড়ার দেহাবশেষ : রিচার্ড মেডোর মতে, দক্ষিণ এশিয়াতে (ভারতীয় উপমহাদেশে) খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ শব্দের আগে পর্যন্ত অশ্বের উপস্থিতির কোন স্পষ্ট অস্থিবিদ্যা সংক্রান্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। প্রকৃত অশ্বের প্রাচীনতম প্রমাণ পাওয়া যায় বালুচিস্থানে কাচি সমতল ভূমিতে বোলান গিরিপথের নিকটবর্তী পিরীক এলাকায় খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ থেকে ১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যবর্তী সময়ের।₃ ১৯৮০ থেকে ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে হরপ্পায় যে খননকার্য সম্পন্ন হয়েছে, সেখানেও অশ্বের উপস্থিতির কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
  5. অন্তেষ্টিক্রিয়া বা মৃতদেহ পোড়ানো : আগুনে পুড়িয়ে মৃতদেহের সৎকারের প্রথা বিকাশ লাভ করেছিল আর্য সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসার ফলে। এই পদ্ধতির সমর্থন মেলে বৈদিক আবেস্তা এবং হোমারীয় সাহিত্যে। লক্ষণীয় হল, হরপ্পার মানুষজন মৃতদেহ কবর দিতেন। হইলার মনে করেন, পরবর্তীকালে পাত্রের মধ্যে রেখে পুড়িয়ে কবর দেয়ার প্রথা (যা 'সমাধি ক্ষেত্র এইচ' নামে পরিচিত) চালু হয়। আর এই পরিবর্তন নতুন মানব গোষ্ঠীর আগমনের প্রতীক।
  6. অগ্নি উপাসনা : অগ্নি উপাসনাকে ইন্দো-আর্যদের অথবা ইন্দো-ইরানীয়দের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য বলে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু হরপ্পা আবিষ্কৃত অগ্নিবেদীগুলি সাহিত্যের বর্ণনার সঙ্গে কিংবা দীর্ঘকালীন ঐতিহ্যবাহী প্রথার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অন্যদিকে, বৈদিক যুগের অগ্নিবেদীর উপাসনার নির্দেশক কিছু কাঠামো খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ থেকে ৩৫০০ অব্দের মধ্যকালীন ইউক্রেনে দেখা যায়।
  7. পশু বলি প্রথা : আর্য সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ আচার হল পশু বলি দেওয়া। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ এবং তৃতীয় সহস্রাব্দে ইউক্রেন ও দক্ষিণ রাশিয়ার অনেক সমাধিক্ষেত্রে অন্তেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠানে পশুবলির অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়। অনুরূপ ব্যাপার দেখা যায় খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্য এবং তারপর পরবর্তীকালে দক্ষিণ মধ্য এশিয়াতে।
  8. অশ্বমেধ : পশুবলি অনেক জনগোষ্ঠীর মধ্যেই প্রচলিত ছিল। কিন্তু অশ্বমেধ ছিল ইন্দো-ইউরোপীয়দের নিজস্ব স্বতন্ত্র প্রথা। বৈদিক সাহিত্যে এই প্রথাটি বিশেষভাবে জনপ্রিয়তা পায়। এই অশ্ববলীর ব্যাপারে ইউরোপ ও মধ্য এশিয়াতে যেমন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায়₄, তেমনটা ভারতের ক্ষেত্রে অনুপস্থিত।
  9. সোম উপাসনা : সোম পূজা পদ্ধতি, যাকে আবেস্তার ভাষায় হাওমা বলা হয়, তা ইরানীয় এবং বৈদিক জনগণের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এই সোম গাছ দক্ষিণ-পূর্ব তুর্কমেনিস্থানের মারজিয়ানাতে টোগোলোক ২১-এর মন্দির চত্বরে পান-অনুষ্ঠানের পানপাত্রের গায়ে লক্ষ্য করা যায়।₅
  10. স্বস্তিকা প্রতীকের ব্যবহার : স্বস্তিকা আর্যদের চিহ্ন বলে বিবেচনা করা হয়। এই ধরনের নকশা ভারতীয় কিংবা পশ্চিম এশিয়ার সাংস্কৃতিতে পাওয়া যায়নি। আর্নেস্ট ম্যাকে মনে করেন, স্বস্তিকা প্রতীকটির উৎপত্তি হয়েছিল এলাম-এ। যার কালসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে হরপ্পা সংস্কৃতি থেকে পুরাতন এবং দক্ষিণ ইরানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। সুতরাং স্বস্তিকা শুধু প্রাক বৈদিকই নয়, এর উৎপত্তি প্রাক হরপ্পা পর্বে।
  11. ভাষাগত ও লিপিগত সাক্ষ্য : ভাষা হল আর্য সংস্কৃতির সবথেকে বড় চিহ্ন। ভাষাতাত্ত্বিকগণ আদিপর্বের ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার আদিরূপ নির্ধারণ করেছেন, যার উৎপত্তি খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম কিম্বা ষষ্ঠ সহস্রাব্দে বলে বিবেচিত হয়েছে। এই ভাষার পূর্বের শাখা ইন্দো-আর্য ভাষার বিকাশ ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০০ অব্দ থেকে। আদি পর্বের ভারতীয় ভাষার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ইরাকের আগাদে বংশের একটি ক্ষুদ্র ফলকে যার সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ২৩০০ থেকে ২১০০ অব্দের মধ্যবর্তী। পূর্ব শাখার ভাষাভাষীদের কথা পাওয়া যায় ষোড়শ থেকে চতুর্দশ খৃষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে মেসোপটেমিয়ার কসাইটস এবং মিতানিদের লেখগুলিতে। কিন্তু ভারতবর্ষে ইন্দো-আর্যদের উপস্থিতির এমন কোন লিপিগত প্রমাণ নেই। ফলে এ কথা বলা সম্ভব নয় যে, এই ভাষাভাষী মানুষজন ভারতবর্ষ থেকে মেসোপটেমিয়াতে গিয়েছিলেন।

আর্যরা ভারতীয় :

অন্যদিকে ১৯৮০ সালে প্রকাশিত কে ডি শেটনা, তাঁর ‘দ্য প্রবলেম অফ এশিয়ান অরিজিন ফ্রম অ্যান ইন্ডিয়ান পার্সপেক্টিভ’ গ্রন্থে দাবি করেন, আর্যরা ছিলেন ভারতেরই আদিবাসী এবং তারাই হরপ্পা সংস্কৃতির স্রষ্টা। এস পি গুপ্তর মতে, "সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতা পূর্ণ বিকশিত বৈদিক সভ্যতারই এক গুরুত্বপূর্ণ দিকের প্রতিনিধিত্ব করে।" তিনি আরো বলেন, হরপ্পা সংস্কৃতি ছিল সিন্ধু ও সরস্বতী উভয় নদীর দান এবং "সম্ভবত শেষোক্ত (সরস্বতী) নদীর দানই বেশি।"₂ এ বিষয়ে কিছু পশ্চিমী প্রত্নতত্ত্ববীদের রচনা তাঁর এই ধরনের চিন্তাধারাকে উৎসাহিত করেছে।

আর্যরা ভারতীয়, স্বপক্ষে যুক্তি :

যাঁরা মনে করেন যে আর্যদের আদি বাসভূমি ছিল ভারতবর্ষ, তাঁরা নিম্নলিখিত যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করেছেন

  1. আর্যদের প্রাচীনতম গ্রন্থ বেদ ভারতে রচিত হয়েছিল। বেদে সপ্তসিন্ধু অঞ্চলের উল্লেখ রয়েছে। বৈদিক সাহিত্যে যে সকল গাছ ও পশু-পাখির উল্লেখ আছে তা ভারতের এই অঞ্চলে দেখা যায়।
  2. যারা দেশ ত্যাগ করে অন্য দেশে গিয়ে বসবাস করে তারা তাদের আদি বাসভূমির কথা স্মরণ করে। কিন্তু বৈদিক সাহিত্যে সপ্তসিন্ধু ছাড়া অন্য কোন দেশের নাম পাওয়া যায় না।
  3. পারগিটারের মতে, উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আর্যদের অভিপ্রয়াণের কোন প্রমাণ ভারতের ইতিহাসে নেই, বরং উত্তর-পশ্চিম হতে আর্যদের ভারতের বাইরে যাওয়া সম্ভব। ঋগ্বেদের নদী স্তোত্রে যে নদীগুলোর উল্লেখ আছে তা গঙ্গা দিয়ে শুরু হয়ে উত্তর-পশ্চিমে সরস্বতী দিয়ে শেষ হয়েছে। এই নদী স্তোত্র থেকে ধারণা করা যেতে পারে যে আর্যরা পূর্ব থেকে উত্তর-পশ্চিমে গিয়েছিল।
  4. আর্যরা বহিরাগত হলে তাদের আদি বাসভূমিতে বেদের মত কোন গ্রন্থ রচিত হয়নি কেন?
এসব যুক্তির মাধ্যমে কিছু ঐতিহাসিক দাবী করেন যে, আর্যদের আদি বাসভূমি ছিল ভারতবর্ষ।

আর্যরা ভারতীয়, যুক্তি খন্ডন :

কিন্তু কোনো কোনো পন্ডিত এই মত খন্ডন করে বেশ কিছু যুক্তি দেখিয়েছেন। তাঁদের যুক্তিগুলো হল :
  1. গাছপালা ও পশুপাখির সঙ্গে প্রথম পরিচয় : বেদে উল্লেখিত গাছপালা ও পশুপাখির নাম থেকে নিশ্চিতভাবে বলা যায় না যে, সপ্তসিন্ধু অঞ্চলই ছিল আর্যদের আদি বাসভূমি। ভারতে প্রবেশ করে প্রথমে তারা এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করায় ঐ এলাকার গাছপালা ও পশুপাখির সঙ্গে তাদের প্রথম পরিচয় ঘটে। এ কারণেই এগুলোর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। বেদও রচিত হয়েছিল ঐ এলাকাতেই।
  2. আদি বাসভূমির স্মৃতি হারিয়ে ফেলে : এমনও হতে পারে যে, দীর্ঘকাল সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে বাস করার ফলে আর্যরা তাদের আদি বাসভূমির সব স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছিল। একারণেই বেদে তার উল্লেখ পাওয়া যায় না।
  3. গঙ্গা নদীর নাম শুধুমাত্র একবার উল্লেখিত : নদী স্তোত্র দিয়ে আর্যদের উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে বাইরে অভিপ্রয়াণ প্রমাণ করা যায় না। বৈদিক সাহিত্যে ৩৯ টি নদীর নাম পাওয়া যায়। তার মধ্যে ঋগ্বেদেই পাওয়া যায় ২৫টি নদীর নাম। কিন্তু গঙ্গা নদীর নাম শুধুমাত্র একবার উল্লেখিত হয়েছে। আর্যরা ভারতের আদিবাসী হলে এবং পূর্ব থেকে পশ্চিমে অভিপ্রয়াণ ঘটে থাকলে, গঙ্গা নদীর সাথে তাদের নিবিড় সম্পর্ক থাকার কথা এবং সে ক্ষেত্রে গঙ্গার নাম বারবার উল্লেখিত হওয়া উচিৎ ছিল।
  4. বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামাজিক উন্নয়ন ঘটেনি : ঋগ্বেদের মত কোন গ্রন্থ অন্য কোন দেশে রচিত হয়নি বলেই বলা যায় না যে, ভারতই ছিল আর্যদের আদি বাসভূমি। এমনও হতে পারে যে, ভারতে আসার আগে বেদের মত গ্রন্থ রচনা করার মত বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামাজিক উন্নয়ন তাদের ঘটেনি।
  5. দক্ষিণ ভারত ছিল আর্য সংস্কৃতির বাইরে : তাছাড়া বলা যায় যে, ভারতবর্ষ আর্যদের আদি বাসভূমি হলে, তারা ভারত ত্যাগের আগেই গোটা ভারতবর্ষে আর্য বসতি ও সংস্কৃতি বিস্তার করতো। কিন্তু উত্তর ভারতের বেশ কিছু এলাকা এবং দক্ষিণ ভারত ছিল আর্য সংস্কৃতির বাইরে।
  6. সংস্কৃত ভাষায় তালব্য বর্ণের প্রাধান্য : সংস্কৃত ভাষায় তালব্য বর্ণের (ন, ং, ৎ) প্রাধান্য দেখা যায়, যা ইউরোপীয় অন্য কোন ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষায় নেই। পন্ডিতেরা মনে করেন যে, ইউরোপ থেকে ভারতে আসার পর দ্রাবিড় ভাষার প্রভাবে এরকম হয়েছে।
  7. বাঘ ও হাতির উল্লেখ নেই : বৈদিক সাহিত্যে সিংহের উল্লেখ থাকলেও বাঘ ও হাতির উল্লেখ নেই। আর্যরা ভারতের আদিবাসী হলে ভারতের এই দুটি প্রাণীর নামের উল্লেখ বৈদিক সাহিত্যে অবশ্যই থাকা উচিৎ ছিল।

বহির্ভারতে হলে কোথায়?

এসব যুক্তির বলে পন্ডিতেরা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে আর্যদের আদি বাসভূমি ছিল ভারতের বাইরে। তাহলে প্রশ্ন ওঠে ভারতের বাইরে ঠিক কোন অঞ্চলে?

১) আর্যরা ইউরোপীয়, পক্ষে যুক্তি :

অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে, আর্যরা ইউরোপ থেকে ভারতে এসেছিল। তাঁদের যুক্তিগুলো নিম্নরূপঃ

  1. আর্য গোষ্ঠীভুক্ত ভাষার আধিক্য : আর্থ ভাষাগোষ্ঠীর সাতটি ভাষার মধ্যে পাঁচটি এখনও ইউরোপের ভাষা, শুধু সংস্কৃত ও পারসিক ইউরোপের বাইরের। ইউরোপে গ্রিক, ল্যাটিন, জার্মান প্রভৃতি আর্য ভাষাগুলোর যে রকম ঘন সন্নিবেশ দেখা যায় ভারতে তা দেখা যায় না। ইউরোপে আর্য গোষ্ঠীভুক্ত ভাষার আধিক্যের কারণে পন্ডিতেরা মনে করেন যে, আদিতে আর্যরা ইউরোপেই বাস করতো।
  2. ইউরোপীয় উদ্ভিদ ও প্রাণীর আধিক্য : বৈদিক সাহিত্যে ওক, উইলো, বার্চ ইত্যাদি গাছ এবং ঘোড়া, গাভী, ষাঁড়, শুকর প্রভৃতি জন্তুর উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রাচ্য দেশের জন্তু হাতি, বাঘ, উট ইত্যাদির কোনো উল্লেখ বৈদিক সাহিত্যে নেই।
  3. নাতিশীতোষ্ণ উদ্ভিদ, কৃষি ও চারণভূমি : অধ্যাপক গাইলস মনে করেন যে, আর্যদের আদি বাসভূমি ছিল দক্ষিণ পূর্ব ইউরোপ। আদি ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষায় সমুদ্রের কোন উল্লেখ না থাকায় ধরে নেওয়া যায় যে আর্যদের আদি বাসভূমি কোন দ্বীপে বা সমুদ্র তীরে ছিলনা। তারা যেসব গাছপালা ও পশুপাখির নাম উল্লেখ করেছে সেগুলো নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের। আর্যরা তখন স্থায়ীভাবে বসবাস এবং কৃষিকাজ শুরু করেছিল। তাদের গৃহপালিত পশুর মধ্যে গরু, ঘোড়া ও ভেড়ার জন্য ভিন্ন ভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক পরিবেশ প্রয়োজন ছিল। তাহলে মনে করতে হবে যে আর্যদের আদি বাসস্থান এমন একটি স্থানে ছিল যেখানে কৃষি ও চারণযোগ্য পরিবেশ কোনটিরই অভাব ছিলনা। সেখানে কৃষিযোগ্য জমি, ঘোড়ার জন্য বিস্তীর্ণ জেপ এবং ভেড়া চরানোর জন্য উঁচু জমি- সবই ছিল। এসবের দিকে লক্ষ রেখে ড. গাইলস বর্তমান অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি অঞ্চলকেই আর্যদের আদি বাসভূমি হিসাবে চিহ্নিত করেছেন।

২) উড়াল পর্বতের কিরঘিজ স্তেপ অঞ্চল :

অধ্যাপক ব্র্যান্ডেস্টাইন মনে করেন যে, উরাল পর্বতের দক্ষিণে কিরঘিজ স্তেপ অঞ্চলই ছিল আর্যদের আদি বাসভূমি। এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য তিনি শব্দতত্ত্বের সাহায্য নিয়েছেন। তাঁর মতে, প্রথম দিকের ইন্দো-ইউরোপীয় শব্দাবলীতে কোন পর্বতমালার পাদদেশে বিস্তীর্ণ স্তেপ ভূমিতে আর্যদের আদি বাসভূমির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। পরবর্তীকালের ইন্দো-ইউরোপীয় শব্দাবলীতে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের জমি, গাছপালা এবং জীবজন্তুর সন্ধান পাওয়া যায়। সেখানে শুষ্ক স্তেপভূমির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শব্দাবলীর পরিবর্তে জলাভূমির স্পষ্ট ইঙ্গিতবাহী শব্দাবলী পাওয়া যায়। বর্তমানে অধিকাংশ পন্ডিতই ব্র্যান্ডেস্টাইনের মতের সমর্থক এবং তাঁরা মনে করেন যে, কিরঘিজ অঞ্চলই আর্যদের আদি বাসভূমি।

আর্যদের আগমনের সময়কাল :

বেদ হচ্ছে আর্যদের প্রাচীনতম সাহিত্য। চারটি বেদের মধ্যে ঋগ্বেদ প্রাচীনতম। বেদ প্রথমে লিখিত আকারে ছিলনা। ঋগ্বেদের স্তোত্রগুলো প্রথম রচিত হয় এবং কানে শুনে স্মৃতিতে ধরে বা আবৃত্তির মাধ্যমে বহুকাল বংশ পরম্পরায় থেকে যায়। অনেক পরে বেদকে লিপিবদ্ধ করা হয়।

ঋগ্বেদের রচনাকাল জানতে পারলে আর্যদের ভারতে আগমনের সময় জানা যায়। জার্মান পন্ডিত ম্যাক্সমুলারের মতে, ঋগ্বেদ কোন একটি নির্দিষ্ট সময়ে রচিত হয়নি। ঋগ্বেদের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন সময় রচিত হয়েছিল। তাঁর মতে, ঋগ্বেদের রচনাকাল ছিল ১২০০-১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে। উইন্টারনিৎস ঋগ্বেদ ও প্রাচীন পারসিক ধর্মগ্রন্থ জেন্দ আবেস্তার ভাষার অসাধারণ সাদৃশ্য দেখে মনে করেন যে, দুটি গ্রন্থই সমসাময়িককালে রচিত হয়েছিল। ভাষাতাত্ত্বিক পন্ডিতদের মতে আবেস্তা রচিত হয়েছিল আনুমানিক ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। কাজেই ঋগ্বেদের রচনার সময়কালও অনুরূপ হতে পারে।

এশিয়া মাইনরের অন্তর্গত বোঘাজকোই নামক স্থানে খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ অব্দের একটি শিলালিপি পাওয়া গেছে। এতে বৈদিক দেবতা ইন্দ্র, বরুণ, মিত্র প্রমুখের অনুরূপ নাম আছে। এ থেকে মনে করা যায় যে, ঋগ্বেদের রচনা শুরু হয়েছিল ১৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে। অধ্যাপক ব্যাশাম মনে করেন যে, ঋগ্বেদের রচনা কাল ছিল ১৫০০-১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। সাধারণত পন্ডিতগণ মনে করেন যে, আর্যরা ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে ভারতে প্রবেশ করেছিল।

ভারতে অভিপ্রায়ণ ও বিস্তার প্রক্রিয়া :

ঋগ্বেদ থেকে আর্যদের ভারতে বসতি স্থাপন ও বিস্তার সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে এ সম্পর্কে আরো কিছু বিবরণ পাওয়া যায়।

ঋগ্বেদে আফগানিস্তানের কাবুল ও স্বাত, পাঞ্জাবের শতদ্র, ইরাবতী, চন্দ্রভাগা, বিপাশা, ঝিলাম এবং সিন্ধু ও সরস্বতী নদীর উল্লেখ আছে। হিন্দুকুশ পর্বতের গিরিপথ দিয়ে আর্যরা ভারতে প্রবেশ করে এবং প্রথমে আফগানিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম ভারতে বসতি স্থাপন করে। আর্যরা আফগানিস্তান সীমান্ত থেকে পাঞ্জাবের সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে 'সপ্তসিন্ধু' আখ্যা দিয়েছিল।

উল্লেখ্য যে ঋগ্বেদের প্রথম দিকের স্তোত্রগুলোতে ভারতের প্রধান নদী গঙ্গা বা যমুনার কোন উল্লেখ নেই। অধ্যাপক রোমিলা থাপার মনে করেন যে, ঋগ্বেদের যুগে আর্যরা দিল্লি অঞ্চল পর্যন্ত বসতি বিস্তার করেছিল। পরবর্তীকালে আর্যরা আরও পূর্বদিকে তাদের বসতি বিস্তার করে। পরবর্তী বৈদিক উৎসগুলোতে দুটি সাগর এবং হিমালয় ও বিন্ধ্য পর্বতের উল্লেখ পাওয়া যায়। গাঙ্গেয় উপত্যকার আবহাওয়া তখন ছিল আর্দ্র ও বৃষ্টিবহুল। ফলে পাথর, ব্রোঞ্জ ও তামার হাতিয়ার দিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে খুব দ্রুত পূর্বদিকে বসতি স্থাপন সম্ভব ছিলনা। খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ অব্দের দিকে লোহার প্রচলন ঘটলে আর্যরা দ্রুত বসতি বিস্তার করতে সক্ষম হয়। লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে গোচারণ ভূমি, বনজ সম্পদ এবং কৃষি ক্ষেত্রের ওপর চাপ পড়ে। পূর্ব ভারতের গঙ্গা-যমুনা উপত্যকা ছিল উর্বর এবং খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ। এসব সম্পদের লোভে এবং পাঞ্জাবে স্থানাভাবের কারণে আর্যরা পূর্ব ভারতের দিকে অগ্রসর হয়েছিল। পরবর্তী বৈদিক যুগে আর্য সভ্যতার কেন্দ্র পাঞ্জাব থেকে মধ্যদেশ বা গঙ্গা-যমুনা উপত্যকায় সরে আসে। দক্ষিণ ভারতে আর্যসভ্যতা বিস্তার সম্পর্কে সঠিক বিবরণ পাওয়া যায় না। দক্ষিণ ভারতে আর্য সভ্যতা সম্পূর্ণভাবে বিস্তার লাভ করেনি।

উপসংহার :

আর্যদের আদি বাসভূমি সম্পর্কে পন্ডিতগণ বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেছেন। তবে বর্তমানে অধ্যাপক ব্র্যান্ডেস্টাইনের মতানুসারে অধিকাংশ পন্ডিতই মনে করেন যে, উরাল পর্বতের দক্ষিণে কিরঘিজ স্তেপ অঞ্চলই ছিল আর্যদের আদি বাসভূমি। 

বেদ হচ্ছে আর্যদের প্রাচীনতম সাহিত্য, যা প্রথমে লিখিত আকারে ছিল না। অনেক পরে বেদ লিপিবদ্ধ করা হয়। চারটি বেদের মধ্যে প্রাচীনতম হচ্ছে ঋগ্বেদ। আর্যদের ভারতে বসতি স্থাপন ও বিস্তার সম্পর্কে ঋগ্বেদ ও পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। সাধারণত পন্ডিতগণ মনে করেন আর্যরা ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হিন্দুকুশ পর্বতের গিরিপথ দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে প্রথমে আফগানিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম ভারতে বসতি স্থাপন করে। এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে তারা 'সপ্তসিন্ধু' নামে আখ্যা দিয়েছিল। পরবর্তীতে তারা পূর্ব ভারতের দিকে অগ্রসর হয়ে তাদের বসতি বিস্তার করে। দক্ষিণ ভারতে আর্য সভ্যতা বিস্তার সম্পর্কে সঠিক বিবরণ পাওয়া যায় না।
--------------xx------------

তথ্যসূত্র :

  1. ডেভিড এ এন্টনির 'দ্য কুরগান কালচার, ইন্দো ইউরোপিয়ান অরিজিন্স এন্ড দা ডোমেস্টিকেশন অফ দা হর্স : আ রিকনশিডারেশন' প্রবন্ধের উপর মারিজা গিমবুটাসের মন্তব্য। দেখুন, কারেন্ট এনথ্রপোলজি, খন্ড ২৭ সংখ্যা ৪ পৃষ্ঠা ৩৬০.
  2. ডেভিড ডাবলু এন্টনি এবং বার্নার্ড ওয়েলস,কারেন্ট এন্ড থ্রোপলজি সংখ্যা ২৯, ১৯৮৮,পৃষ্ঠা ২৪৩.
  3. রিচার্ড মেডো, 'কন্টিনিউটি এন্ড চেঞ্জ ইন দা এগ্রিকালচারঅফ দা গ্রেট ইন্ডাস ভ্যালি : দ্য প্যালিও এথনো বটানিক্যাল এন্ড জুয়ারলজিকাল এভিডেন্স', জিম জি স্যাফার, 'ইন্দাস ভ্যালি, বালুচিস্তান এন্ড হেলমানান্ড'.
  4. মৃত্যুঞ্জয় কুমার, দা পুরুষমেধ অ্যান্ড অশ্বমেধ : আন হিস্টোরিকাল স্টাডি' পিএইচডি গবেষণা পত্র, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, 1997 পৃষ্ঠা নম্বর ১০৮ - ১৭
  5. এসপি গুপ্ত সম্পাদিত 'দ্য লস্ট সরস্বতী এন্ড দা ইন্ডাস সিভিলাইজেশন', কুসুমাঞ্জলি প্রকাশন, যোধপুর, ১৯৯৫, পৃষ্ঠা ১৮১-১৮৪

মন্তব্যসমূহ

সবচেয়ে বেশি পঠিত প্রশ্নোত্তর

কোপার্নিকান বিপ্লব বলতে কি বোঝ ?

কোপার্নিকান বিপ্লব বলতে কি বোঝ ? আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের অগ্রগতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে যার নাম প্রথমেই উচ্চারিত হবে তিনি হলেন একজন পোলিশ যাজক নিকোলাস কোপার্নিকাস (1473-1543)। রক্ষণশীল যাজক সম্প্রদায়ের অংশ হয়েও তিনি তার গবেষণার মধ্য দিয়ে চিরাচরিত পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের ধারণাকে বাতিল করে আধুনিক কসমোলজির সূচনা করেন। এই ঘটনাই কোপার্নিকান বিপ্লব নামে পরিচিত। নিকোলাস কোপার্নিকাস কোপার্নিকাসের আগে, খ্রিস্টীয় ধ্যান-ধারণার সঙ্গে সমন্বয়িত অ্যারিস্টটল ও টলেমির সৃষ্টিতত্ত্বই মান্যতা পেত। মনে করা হত যে, পৃথিবী অন্তরীক্ষের জ্যোতির্মন্ডলীর বাইরে অবস্থানরত এক মাটির জগৎ। বিপুল বিশ্বকে দ্যুলোক ও ভুলোকে বিভক্ত করে রাখা হত। দ্যুলোকে অবস্থানরত গ্রহ নক্ষত্র রাজি স্বর্গীয় ইথার দ্বারা নির্মিত। এগুলি অপরিবর্তনীয় অক্ষয় এবং এর গতি সংক্রান্ত নিয়মাবলী পৃথিবীতে অজ্ঞাত ও অপ্রাসঙ্গিক। আর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ মনে করত যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে অবস্থিত নিশ্চল পৃথিবী এবং সূর্য পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। কোপার্নিকাস তার গবেষণায় ( On the Revolutions of the Heavenly Spheres -- 1543) দেখালেন যে...

গ্লাসনস্ত ও পেরেসট্রয়িকা কি? ঠান্ডা যুদ্ধের প্রশমনে এগুলোর ভূমিকা কি?

গ্লাসনস্ত ও পেরেসট্রয়িকা কী? গ্লাসনস্ত ও পেরেসট্রয়িকা গ্লাসনস্ত ও পেরেসট্রয়িকা : গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রইকা শব্দ দুটি রুশ ভাষার অন্তর্ভুক্ত। গ্লাসনস্ত শব্দের অর্থ মুক্ত চিন্তা এবং পেরেস্ত্রইকা শব্দের অর্থ পুনর্গঠন । গ্লাসনস্ত ও পেরেসট্রয়িকার পটভূমি : ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাশিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কার্যকরী করার জন্য কমিউনিস্ট সরকার। এই সরকারের মূলনীতি ছিল সম্পদের উপর সামাজিক মালিকানা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য দূর করে একটি শোষণহীন সমাজ ও অর্থ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। এই অর্থ ব্যবস্থা ছিল ধনতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থার বিপরীত একটি ব্যবস্থা। ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের ফলে যে ধানতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এই আর্থিক ব্যবস্থা রাশিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে ধনতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষক দেশ আমেরিকার সঙ্গে রাশিয়ার মতাদর্শ গত দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এই দ্বন্দ্ব অর্থনৈতিক পরিসরের গণ্ডি পেরিয়ে ক্রমশ রাজনৈতিক চেহারা নেয়। ফলে শুরু হয় আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে ঠান্ডা লড়াই বা কোল্ড ওয়ার। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে ঠান্ডা লড়াইয়ের ফল...

আধুনিক বিজ্ঞানে গ্যালিলিওর অবদান আলোচনা কর।

আধুনিক বিজ্ঞানে গ্যালিলিওর অবদান আলোচনা কর। কোপারনিকাস ও কেপলারের পর বিজ্ঞান বিপ্লবের তৃতীয় প্রধান চরিত্র হলেন গ্যালিলিও গ্যালিলি(১৫৬৪-১৬৪২)। পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামরিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ছিলেন তিনি। মহাকাশ গবেষণায় তিনি তার নিজের হাতে তৈরি দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে কোপার্নিকাসের ধারণাকে অভ্রান্ত প্রমাণ করেন এবং পতনশীল বস্তু সম্পর্কে এরিস্টটলের বক্তব্য ভুল প্রমাণ করে নতুন তত্ত্ব তুলে ধরেন। গ্যালিলিও পতনশীল বস্তুর গতি সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের বক্তব্য ছিল, কোন একটি পদার্থের ওজনের ওপর নির্ভর করে তার গতি। ফলে একটি জিনিসের মাটিতে পড়ার গতি একটি হালকা জিনিসের থেকে দ্রুততর হয়। 1592 সালে গ্যালিলিও The Motion (De Motu) গ্রন্থে অ্যারিস্টোটলের এই ধারণার বিরোধিতা করলেন এবং বললেন যে, প্রত্যেকটি পদার্থের একটি নির্দিষ্ট ওজন আছে এবং একটি বিশেষ মাধ্যম দিয়ে যদি একটি পদার্থ চলে যায় সেই চলার গতি নির্ভর করে মাধ্যমটির ঘনত্বের উপর। পদার্থের ওজনের তারতম্য এখানে গতি নির্ধারণ করে না। কোপার্নিকাসের সমর্থক ছিলেন গ্যালিলিও। তিনি তাঁর নিজের তৈরি দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে আবিষ্কার করলেন য...