উপনিবেশিক ভারতে আধুনিক শিল্পায়নের অগ্রগতি :
![]() |
উপনিবেশিক ভারতে আধুনিক শিল্পায়নের অগ্রগতি |
Growth of Modern Industries from the time of British Colonization in india
ভারতে আধুনিক পুঁজিবাদী অর্থনীতির উত্তরণে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় অর্থনীতির এই রূপান্তরের পেছনে ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কুটির শিল্পভিত্তিক ভারতীয় অর্থনীতি ম্যানচেস্টার, ল্যাঙ্কাশায়ারের মত বৃহৎ শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ভয়ংকর ভাবে পিছিয়ে পড়ে।
ভারতীয় শিল্প বাণিজ্যের গতিরোধ :
এই সময়ে প্রধানত তিনটি কারণে ভারতীয় শিল্প-বাণিজ্যের গতি রুদ্ধ হয়ে আসে।
- প্রথমত, ভারতীয় বস্ত্রের উপর ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ শুল্ক আরোপ এবং ‘ক্যালিকো’ ও ‘মসলিন’ বস্ত্রের উপর যথাক্রমে ৬৭.৫ ও ৩৭.৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ।
- দ্বিতীয়ত, ১৮১৩ সালের চার্টার অ্যাক্টে ভারতের বাজার ইউরোপীয় বণিকদের কাছে উন্মুক্ত করায় দেশীয় বণিক বিশেষত বস্ত্র ব্যবসায়ীরা ভয়ংকর সংকটে পড়ে।
- রেলপথের বিশিষ্ট ইংরেজ প্রোমোটার আর এম স্টিফেনসন বলেছিলেন, ভারতের রেলপথ তৈরি হলে সামরিক নিরাপত্তার পাশাপাশি ব্রিটিশ বাণিজ্যের সুরক্ষা এবং ভারতের কাঁচামাল রপ্তানি ও ইংল্যান্ড থেকে শিল্পজাত পণ্য ভারতে আনা সহজ হবে; যার সুফল পুরোটাই ভোগ করবে ব্রিটিশ সরকার।
আধুনিক শিল্পায়নের অগ্রগতি :
ব্রিটিশ শাসনের ফলে ভারতের আধুনিক পুঁজিভিত্তিক শিল্পায়নের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। তবে বিশাল দেশের তুলনায় শিল্পায়নের অগ্রগতি ছিল অত্যন্ত অপ্রতুল। এই সীমিত অগ্রগতির প্রধান কারণ, ভারতের শিল্পের বিকাশ ছিল বিদেশি পুঁজিপতিদের নিয়ন্ত্রণে এবং ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ভারতের প্রকৃত শিল্পায়নের পক্ষপাতী ছিলেন না।
ইউরোপীয় শিল্পোদ্যোগের কারণ বা উদ্দেশ্য :
ভারতে ইউরোপীয় শিল্প উদ্যোগের কারণ বা উদ্দেশ্য ছিল —
- ভারতের বাণিজ্য ও শিল্পনীতি ইউরোপীয় বণিকদের অনুকূলে তৈরি করা হয়েছিল।
- ব্রিটিশ শাসনাধীনে ইউরোপীয়দের সুলভ শ্রমিক পাওয়ার সুবিধা ছিল।
- শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সস্তায় সংগ্রহ ও পরিবহনের সুযোগ ছিল
- ইউরোপীয়দের প্রয়োজনীয় মূলধন সহজে এবং অতি অল্প সুদে পাওয়ার সুযোগ ছিল। বিদেশি ব্যাংক, বীমা ও এজেন্সি কোম্পানিগুলি ইউরোপীয়দের সহজ শর্তে ঋণ দিত।
- ভারতে এবং পার্শ্ববর্তী দেশগুলিতে বিদেশি শিল্পজাত পণ্যের বিরাট চাহিদা ছিল।
- ব্রিটিশ ভারতের সরকারি কর্মচারীরা ইউরোপীয়দের অনুকূলে কাজ করতো।
- ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের ফলে নতুন নতুন শিল্পের যন্ত্রপাতি তৈরি হতে শুরু করে। ফলে শিল্প স্থাপন লাভজনক হয়ে ওঠে।
ইউরোপীয় শিল্পোদ্যোগের প্রকৃতি :
ভারতে আধুনিক শিল্পের বিকাশে ইউরোপীয় উদ্যোগের প্রকৃতি ছিল নেতিবাচক। কারণ —
- ইউরোপীয়রা ভারতকে আধুনিক শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে দেখতে চাইনি।
- এই কারণে তারা ভারতে ভারী শিল্পের পরিবর্তে ভোগ্যপণ্যের শিল্প গড়ে তোলায় আগ্রহ দেখায়।
- তাদের লক্ষ্য ছিল, ভারতীয় শিল্প ধ্বংস করে ইউরোপীয় শিল্পের সম্প্রসারণ করা। ঐতিহাসিক বিপানচন্দ্র স্যার জর্জ পেইনের তথ্য উদ্ধৃত করে দেখান যে ১৯১১ সাল পর্যন্ত ৬৬০ কোটি পাউন্ড বিলগ্নী করা হয়।
- ইউরোপীয়রা মূলত কৃষিভিত্তিক বাগিচা শিল্প গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়েছিল।
ইউরোপীয় উদ্যোগে আধুনিক শিল্পের বিকাশ :
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময় :
এই পর্বে ইউরোপীয় মালিকানায় প্রধানত কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে ওঠে। যেমন —
- বস্ত্রবয়ন শিল্প : ১৮১৮ সালে হাওড়ায় ‘বাউরিয়া কটন মিল’, ১৮৩৫ সালে জেমস ল্যান্ডন গুজরাটের ব্রোচে ব্রিটিশ উদ্যোগে এবং ১৮৫৩ সালে পন্ডিচেরিতে ফরাসি উদ্যোগে সুতা কাটার কল স্থাপিত হয়। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতের ৩৩৫ টি বস্ত্রশিল্পের মধ্যে ইউরোপীয় উদ্যোগে গড়ে ওঠে মাত্র ৯টি।
- পাট শিল্প : হুগলির রিষড়ায় ১৮৫৫ সালে জর্জ অকল্যান্ড প্রথম পাটকল তৈরি করেন। এরপর বোর্নিও কোম্পানির উদ্যোগে বরানগরে (১৮৫৯), সিরাজগঞ্জে ও গৌরীপুরে (১৮৬০) পাটকল তৈরি হয়। ১৯১৩-১৪ সালে ভারতে মোট পাটকলের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৪ এবং পাটকল শ্রমিকের সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ ১৬ হাজার।
- কাগজ শিল্প : ১৮৭০ সালে প্রথম কাগজ কল প্রতিষ্ঠিত হয় যার নাম ‘বালি পেপার মিল’। এরপর লখনৌ (১৮৭৯), টিটাগর (১৮৮২), পুনা (১৮৮৫), রানীগঞ্জ (১৮৮৯), এবং কাঁকিনাড়াতে (১৮৯৩-৯৪) কাগজ কল স্থাপিত হয়। ১৮৭০-১৮৯৪ সালের মধ্যে তিনটি বৃহত্তর কাগজশিল্প গড়ে ওঠে। এরা হল, 'ইম্পেরিয়াল পেপার মিল', 'বেঙ্গল পেপার মিল' এবং 'টিটাগর পেপার মিল'।
- বাগিচা শিল্প : বাগিচা শিল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল নীল, চা ও কফি-ভিত্তিক শিল্প। ১৮৩২ সালে এন্ডু চার্লট্রন এদেশে প্রথম চা গাছ রোপন করেন। হুগলির চন্দনগরে ১৭৮০ সালে সর্বপ্রথম নীল গাছ রোপন করেন কার্ল ব্লুম। ১৮২৩ সালে সর্বপ্রথম কফি চাষ শুরু হয় বাংলাদেশে। ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে ক্যাপ্টেন চার্লস আলেকজান্ডার ব্রুস নামে ইংরেজ বণিক 'আসাম টি কোম্পানি' গড়ে তোলেন। ১৮৫১ সালে ৫১ টি এবং ১৯০২ সালে ৩০২ টি চা বাগান গড়ে ওঠে।
- চর্ম শিল্প : ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগে ১৮৫৪ সালে প্রথম ভারতীয় চর্মশিল্পে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুরু হয়। মাদ্রাজে গড়ে ওঠে বৃহত্তম চর্ম শিল্প কারখানা। ১৮৬০ সালে কানপুরে গড়ে ওঠে ‘হার্নেস এন্ড স্যাডলারি ফ্যাক্টরি’।
- লৌহ ইস্পাত শিল্প : ব্রিটিশ শিল্পপতিদের উদ্যোগে বাংলা ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে সর্বপ্রথম লৌহ ও ইস্পাত শিল্প গড়ে ওঠে। এরপর ১৮৭৪ সালে ‘বেঙ্গল আয়রণ ওয়ার্কস কোম্পানি’, ১৮৮৯ সালে ‘বেঙ্গল আইরন এন্ড স্টিল কোম্পানি’ এবং ১৯১৮ সালে ‘ইন্ডিয়ান আয়রন এন্ড স্টিল কোম্পানি’ গড়ে তোলা হয়।
- কয়লা শিল্প : কয়লা শিল্পের উন্নতি প্রথম ইউরোপীয় উদ্যোগে শুরু হয়। ১৮২০ সালে রানীগঞ্জে প্রথম কয়লা খনি আবিষ্কৃত হয়। ১৮৫৭ সালে ৫৬ টি এবং ১৯০৯ সালে ১১৯ টি কোম্পানি গড়ে ওঠে শুধু বাংলাতেই। ভারতে ১৯১৩-১৪ সালে উৎপাদিত কয়লার পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ১৬,৪৬৪,২৬৩ টন।
- অন্যান্য শিল্প : এছাড়া সিমেন্ট, ইঞ্জিনিয়ারিং, কাচ, দেশলাই, রং ও অন্যান্য রাসায়নিক শিল্প গড়ে ওঠে ইউরোপীয়দের উদ্যোগে।
ভারতীয় উদ্যোগে আধুনিক শিল্পের বিকাশ :
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে :
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ভারতীয় মালিকানায় অনেক আধুনিক শিল্প গড়ে ওঠায় শিল্পোদ্যোগে নতুন অধ্যায় শুরু হয়।
- বস্ত্রবয়ন শিল্প : ১৮১৮ সালে কলকাতার কাছে ঘুসুড়িতে প্রথম বস্ত্র তৈরীর কারখানা তৈরি হয় ভারতীয় মালিকানায়। ১৮৫৩-৫৪ সালে কাওয়াসজি নানাভাই দাভর ‘বোম্বে স্পিনিং এন্ড উইভিং কোম্পানি’ গড়ে তোলেন। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ডঃ সুনীল সেনের ‘An Economic History of Modern India’ গ্রন্থে দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯২২ সালে ভারতীয় উদ্যোগে তৈরি কাপড়ের কলের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৩৫ টিতে।
- চা শিল্প : ভারতীয় মালিকানায় ১৮৪৫ সালে 'আসাম চা কোম্পানি গড়ে ওঠে। চা শিল্পের উন্নতি কল্পে মতিলাল শীল, মির্জা ইস্পাহানি, দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রমূখ পুঁজিপতিরা প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেন।
- কয়লা শিল্প : প্রথম থেকেই কয়লা শিল্পে ভারতীয় মালিকানা ছিল। এই সময় দ্বারকানাথ ঠাকুর বেশ কয়েকটি কয়লা খনির মালিক হন। 'কার, টেগর এন্ড কোম্পানি’র মাধ্যমে তিনি কয়লা খনিতে মূলধন বিনিয়োগ করেন। ১৮৯৭ সালে ভারতীয় মালিকানায় বর্ধমান জেলায় চল্লিশটি, মানভূম ও ছোটনাগপুর জেলায় ৬২টি কয়লাখনি ছিল।
- লৌহ-ইস্পাত শিল্প : বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, নওয়াল কিশোর এবং জামশেদজি টাটা লৌহ-ইস্পাত শিল্পে বিপ্লব এনেছিলেন। ১৮৭২ সালে রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ও তাঁর ইংরেজ বন্ধু স্যার জন মার্টিন ১৭৭২ সালে মার্টিন এন্ড কোম্পানি গড়ে তোলেন। নওয়াল কিশোর গড়ে তোলেন লখনৌ আয়রন এন্ড স্টিল কোম্পানি। ১৯০৭ সালে জামশেদজি টাটা প্রতিষ্ঠা করেন টাটা আয়রন এন্ড স্টিল কোম্পানি।
- ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প : শিবপুরের বাসিন্দা কিশোরী লাল মুখার্জি প্রথম ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। তিনি ১৮৬৭ সালে শিবপুরে লোহার কারখানা ও যন্ত্রপাতি তৈরীর ছোট কারখানা তৈরি করেন। ১৯১১ সালে চিদাম্বরাম পিল্লাই মাদ্রাজে গড়ে তোলেন জাহাজ নির্মাণ শিল্প।
- রাসায়নিক শিল্প : রাসায়নিক দ্রব্য ও ঔষধপত্র তৈরীর ক্ষেত্রে ভারতীয়দের উদ্যোগ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ১৮৯২ সালে বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় গড়ে তোলেন বেঙ্গল কেমিক্যাল এন্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস’। ডক্টর নীলরতন সরকার গড়ে তোলেন জাতীয় সাবান কারখানা।
- অন্যান্য শিল্প : ১৯০৫ থেকে ১৯১১ সালের স্বদেশী আন্দোলনের সময় ভারতীয় উদ্যোগে চা, চিনি, কাগজ, কাঁচ, চর্ম, তেল, চিরুনি, দেশলাই, সিগারেট, সিমেন্ট, লবণ, গেঞ্জি, ধাতব দ্রব্য, বিলাস দ্রব্য ইত্যাদি শিল্প গড়ে ওঠে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় শিল্পের অগ্রগতি :
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আমদানি হ্রাস পাওয়ায় ও যুদ্ধে চাহিদা পূরণের জন্য শিল্পায়নের অগ্রগতির হার বৃদ্ধি পায়। যুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে রেজিস্টার্ড কোম্পানির সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৫৬। ১৯১৯-২০ সালে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৯৪৮ এবং ১৯২০-২১ সালে ১০৩৯। এই বৃদ্ধির কারণ হল এই সময়ে সরকার শিল্পায়নের জন্য একটি সুস্পষ্ট নীতি গ্রহণ করে এবং ১৯১৬ সালে শিল্প কমিশন নিয়োগ করেন।
তবে ১৯১৯ সালে মন্টেগু-চেমসফোর্ড রিপোর্টে শিল্পকে প্রাদেশিক সরকারের আওতাভুক্ত করা হয়। কিন্তু এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক সম্পদ ও কলাকৌশল না থাকায় প্রাদেশিক সরকারগুলি শিল্পায়নের উপযোগী কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
১৯২২ সালের সংঘটিত অর্থ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী শিল্পায়নের জন্য সংরক্ষণ নীতি গ্রহণ করা হয় এবং ১৯২৩ সালে শুল্ক বোর্ড গড়ে তোলা হয়। ফলে ভারতীয় শিল্প-সংস্থাগুলির উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
কিন্তু ১৯২৭ সালের পর পরিস্থিতির অবনতি ঘটে —
- প্রথমত, এ সময় শুল্কনীতি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের অনুকূলে নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। ১৯৩২ সালের অটোয়া চুক্তিতে এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফলে ভারতীয় শিল্পসম্ভার অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়।
- দ্বিতীয়তঃ ১৯২৯ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত অর্থনৈতিক মন্দার ফলে জনগণের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পায়। ফলে দেশীয় শিল্পের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর শিল্পের অগ্রগতি :
তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পরিস্থিতি ভারতের শিল্পায়নের অগ্রগতির পক্ষে অনুকূল হয়ে ওঠে —
- প্রথমত, ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শুল্কনীতির প্রকৃতি কিছুটা পাল্টে যায়। কারণ, ১৯৩০ এর দশক থেকে জাপান ও জার্মানির সঙ্গে বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতায় ব্রিটেন পিছিয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় ইংল্যান্ড নিজেদের এবং তাদের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলির শিল্পকে শুল্ক সংরক্ষণের আওতায় আনতে বাধ্য হয়।
- দ্বিতীয়ত, ভারতে অসহযোগ ও বয়কট আন্দোলনের ফলে ভারতে বিদেশি পণ্যের চাহিদা কমে যায় এবং দেশীয় পণ্য ক্রয়ের দিকে নজর দেয়।
- তৃতীয়ত, মনে রাখা প্রয়োজন, ১৯২৯-৩০ সালের বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা পরবর্তী সময়ে ভারতের শিল্পায়নের পক্ষে সাপে বর হয়েছিল। এই সময় পশ্চিমী দুনিয়ায় মন্দার কারণে পাট ও চায়ের মত রপ্তানির বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু ভোগ্যপণ্য শিল্পে দেশের বাজার চাঙ্গা হয়ে ওঠে। ফলে রপ্তানি বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত দেশীয় পুঁজি বিশ্ববাজার থেকে কম দামে যন্ত্রপাতি কিনে ভারতের কলকারখানা স্থাপন শুরু করে।
উপনিবেশিক ভারতে আধুনিক শিল্পায়নের অগ্রগতির ধারা
(১৯২২-২৩ থেকে ১৯৩৮-৩৯)
পণ্য সামগ্রী | পরিমাণ | ১৯২২-২৩ | ১৯৩৮-৩৯ |
---|---|---|---|
সিমেন্ট | টন | ১,৯৩,০০০ | ১১,৭০,০০০ |
কয়লা | মিলিয়ন টন | ১৯ | ২৮.৩ |
সুতিবস্ত্র | মিলিয়ন গজ | ১,৭১৩.৫ | ৪,২৬৯.৩ |
পাট | মিলিয়ন গজ | ১,১৮৭.৫ | ১,৭৭৪ |
দেশলাই | গ্রস বাক্স | ১৬,৫০০,০০০ | ২১,১০০,০০৯ |
কাগজ | টন | ২৩,৫৭৬ | ৫৯,১৯৮ |
লৌহপিন্ড | টন | ৪৫৫,০০০ | ১,৫৭৫,৫০০ |
চিনি | টন | ৮৪,০০০ | ১,০৪০,০৪৮ |
সালফিউরিক অ্যাসিড | হন্দর | ৫২৯,৬৩৭ | ৬০৭,০০০ |
ইস্পাত খন্ড | টন | ১৩১,০০০ | ৯৭৭,৪০০ |
এই পর্বে এভাবে শিল্পায়নের ফলে ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এবং এই সূত্র বিদেশ থেকে ভোগ্যপণ্যের আমদানি কমে যায়। ১৯২৬-২৭ সালের ৩৭ শতাংশ আমদানি ১৯৩৮-৩৯ সালে কমে দাঁড়ায় ২০ শতাংশে।
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময় শিল্পের অগ্রগতি :
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে ভারতের ভারী শিল্পের অগ্রগতি ছিল অভাবনীয়। এই অগ্রগতির পরিমাণ ছিল প্রায় আড়াই গুণ।
- ইস্পাত এবং সিমেন্ট শিল্পে অগ্রগতির হার ছিল ব্যাপক। এই পর্বে টাটা আইরন এন্ড স্টিল কোম্পানি, মহীশূর লৌহ ইস্পাত ওয়ার্কস, ইন্ডিয়ান আয়রন এন্ড স্টিল কোম্পানি ব্যাপকভাবে উৎপাদন শুরু করে।
- সিমেন্ট শিল্পের ক্ষেত্রে এসোসিয়েটেড সিমেন্ট কোম্পানির একচেটিয়া প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩৭ সালে ডালমিয়া গোষ্ঠী পাঁচটি নতুন সিমেন্ট কারখানা শুরু করে।
- কাগজ শিল্পে প্রথমে টিটাগর ও বেঙ্গল পেপার মিল একচেটিয়া আধিপত্য করলেও পরবর্তীতে ভারতীয় পুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটে।
- ১৯২০ এর দশকে পরিশুদ্ধ চিনির শতকরা ৩.৬ ভাগ ভারতে উৎপাদিত হত। ১৯৩০ এর দশকে ভারত সরকার ১৫০ ভাগ শুল্ক আরোপ করলে ভারতে চিনিকলের সংখ্যা ২৭ থেকে ১৫০ এ দাঁড়ায়।
স্বাধীনতার প্রাক্কালে শিল্পের অগ্রগতি :
স্বাধীনতার প্রাক্কালে ভারতের শিল্পোদ্যোগের ক্ষেত্রে দেশীয় শিল্পপতিদের অগ্রগণ্য ভূমিকা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময় ভারতের শিল্প অর্থনীতিতে শতকরা ২৫ ভাগ ছিল বিদেশীদের আওতায়, বাকিটায় দেশীয় পুঁজির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতীয় শিল্পপতিগণ একদিকে ব্রিটিশ পরিচালিত কোম্পানিগুলিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনেন, অন্যদিকে বহুজাতিক সংস্থার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করতে শুরু করে। এভাবে একে একে ডালমিয়া বেনেট কোলম্যানের, থাপার গ্রিভস কটনের, বিড়লা কটন এজেন্সির এবং টাটা ম্যাকনিল বেরি ও কিলবার্ণ-এর উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করে।
এই সময় ব্রিটিশ ও ভারতীয় শিল্পপতিদের পুঁজি লগ্নির পরিমাণ ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ায় ভারতীয় অর্থনীতিতে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার দ্রুত প্রসার লাভ করে। ভারতীয় ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ ছিল মূলত রিজার্ভ ব্যাংক ও ইমপেরিয়াল ব্যাংকের ওপর, যা ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারতের ব্যাংক আমানতে বিদেশী পুজির পরিমাণ শতকরা ১৭ শতাংশে নেমে আসে।
শিল্পায়নের অগ্রগতির মূল্যায়ন :
উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর শিল্পোন্নয়নের ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি হলেও তা আশাব্যঞ্জক ছিল না। সরকারের বৈষম্যমূলক নীতি, কৃষিজীবী সম্প্রদায়ের অবর্ণনীয় দারিদ্র, ভারতীয় পুজাপতি সম্প্রদায়ের প্রয়োজনীয় মূলধনের অভাব, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাপান সহ অন্যান্য দেশগুলির প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা ইত্যাদি কারণে ভারতের আধুনিক শিল্পায়ন গতি লাভ করতে পারেনি। পরিসংখ্যান ও তথ্য বলছে -
- ভারতের বিশাল জনগণের শতকরা দুভাগ শিল্প অর্থনীতির আওতায় এসেছিল।
- ভারতীয় পুঁজিপতি শ্রেণির শ্রীবৃদ্ধি ঘটলেও ভারতীয় অর্থনীতির নীতি নির্ধারণে তাদের কোন ভূমিকা ছিল না। কারণ, তারা বিদেশি শাসকবর্গের কোন সহানুভূতি বা সমর্থন পাননি।
এই পরিস্থিতিতে ১৯৩৮ সালে জাতীয় কংগ্রেস একটি জাতীয় পরিকল্পনা কমিটি গঠন করে। এই পরিকল্পনার সঙ্গে এ ডি শরফ, সারাভাই, ওয়ালচাঁদ হীরাচাঁদ প্রমুখ শিল্পপতিগণ যুক্ত হন এবং জাতীয় অর্থনীতির বিকাশের জন্য মুম্বাই পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন। এই পরিকল্পনায় ভারতীয় অর্থনীতির বিকাশের জন্য ১৫ বৎসরের মেয়াদ-এর ভিত্তিতে ১০,০০০ (দশ হাজার) কোটি টাকা লগ্নীর প্রস্তাব করা হয়। এই প্রস্তাবে, কৃষিক্ষেত্রে জমিদারী প্রথার বিলোপ সাধনেরও সুপারিশ করা হয়েছিল। লক্ষণীয় বিষয় হল, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এই মুম্বাই পরিকল্পনাকে সামনে রেখেই সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু ভারতে আধুনিক শিল্পায়নের অগ্রগতি ঘটিয়েছিলেন।
-------------xx-----------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন